যাদুকরি নেতৃত্বে দেশ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি
মুক্তিবাণী অনলাইন ডেক্সঃ

ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ৮ মাস পূর্ণ করলো আজ। নির্বাচিত সরকারের জন্য ৮ মাস কম সময় হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটা মোটেই কম নয়। নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কয়েকজন উপদেষ্টা ‘কাজের চেয়ে কথা বেশি’ বললেও প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস কথা কম-কাজ বেশি নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। নানা বাদ-প্রতিবাদ-বিতর্ক-হিন্দুত্ববাদী ভারতের চ্যাণক্যনীতির ষড়যন্ত্র, পলাতক হাসিনার কাল নাগিণীর মতো ক্ষণে ক্ষণে ফণা তোলার মধ্যেই ড. ইউনূস দেশকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গেছেন। কিছু বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতা থাকলেও ৮ মাসেই প্রফেসর ইউনূস যা দেখিয়েছেন-মানুষ তাতে মোহমুগ্ধ। ‘বিশ্বমাঠের খেলোয়াড়’ ইউনূস সারাজীবন রাজনীতির বাইরে থাকলেও শাসক হিসেবে তিনি রাজনীতির আইডল। সময় যতো যাচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মানুষ ততোই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। গভীর অথচ শান্ত সমুদ্রের মতোই ধীর স্থির ড. ইউনূস। সংস্কারের নামে ‘বছরের পর বছর’ ক্ষমতায় থাকা যেমন অনুচিত; তেমনি ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে’ হবে এমন দাবির প্রতি নমনীয় হয়ে ‘হাল ছেড়ে দেয়া’ অপ্রত্যাশিত। ক্যারিশমাটিক নেতা ড. ইউনূসের উচিত ১৫ বছর ধরে ভোটের অধিকার হারানো মানুষের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আর নির্বাচনের পর মর্যাদা নিয়ে বিজয়ীর বেশে চলে যাওয়ার পথ নিশ্চিত করা। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।

সরকার প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের ‘রং হেডেড’ হাসিনার মতো তর্জন-গর্জন নেই। পরিকল্পনায় যা আছে সেটি তিনি করে দেখান। বিশ্বনেতারা তাকে সমীহ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপর শৃংখলা ফেরানো, জুলাই-আগস্ট হত্যাকা-ের জন্য জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার, ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, ব্যাংকিং সেক্টরে গ্রাহক আস্থা ফেরানো, সংস্কার রোডম্যাপ, ব্যাপকভিত্তিক আন্তর্জাতিক সমর্থন, প্রশাসনে শূন্য দুর্নীতি, অস্থিরতা-সংকটে দক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, নতজানু পররাষ্ট্র নীতির খোলস থেকে বের হয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিশা, বিজাতীয় সংস্কৃতি বর্জনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশের তালিকায় ১১২তম অবস্থান থেকে দেশকে ৪৭তম অবস্থানে এনেছেন। এছাড়া বিমসটেক সম্মেলন, আসিয়ান সদস্য, চীন সফরের পর এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে রাজী করানো, জাতিসংঘের মহাসচিবকে ঢাকায় নিয়ে আসা, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের আগে ১৪শ’ ছাত্রজনতাকে হত্যার প্রমাণ উঠে আসা ইত্যাদি সাফল্যের পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাদের কাঁপন ধরিয়েছেন। তিনি তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। স্বপ্ন দেখান ‘থ্রি-জিরো’ থিওরি বাস্তবায়নের। তিনি সি-িকেট ভেঙ্গে দিয়ে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং আইন শৃংখলা পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রায় দেড় যুগ পর এবার দেশের মানুষ মুক্তপরিবেশে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছে। হিমালয়স্পর্শী ইউনূসের কাছে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী ভারতের লাল চোখ এখন ধূসর। চারদিকে তার অভূত কূটনৈতিক সাফল্যের জয়ধ্বনি। একের পর এক দেখাচ্ছেন ম্যাজিক। হয়ে উঠেছেন এক অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক। তবে হাসিনার অলিগার্ক আমলাদের অপসারণ, রাঘব বোয়ালদের গ্রেফতার, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের মিছিল, প্রশাসনে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তরুণ নেতাদের আস্ফালন নিয়ন্ত্রণ, বিচার প্রক্রিয়ায় গতিহীনতা, সংস্কার কমিশনের কিছু সদস্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক, শিল্প বিনিয়োগে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের সুরাহা করতে পারেননি।

রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট শপথ নেয় নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন ‘অন্তর্বর্তী সরকার’। ৮ মাস পেরিয়ে আজ (৯ এপ্রিল) ৯ মাস এ পা দিয়েছে। হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রের দেড় দশকে সর্বান্তকরণে ধসিয়ে দেশকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব পড়ে তার উপর। যদিও এই সরকারের ২৩ উপদেষ্টার অনেকের কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এটা ঠিক সরকার গঠনের আগে তার খুব একটা বাছ-বিচারের সময় মেলেনি। ছাত্র-জনতা, আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, সুশীল সমাজের প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করা হয় সরকার। দায়িত্ব নিয়েই বহু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টাদের কারো কারো গ্রহণযোগ্যতা এবং অতীত কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক ওঠে। তবে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিলো ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাজিয়ে যাওয়া প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গাজা পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে। আর দেড় দশকের স্বেচ্ছাচারিতায় হাসিনা ধ্বংস করে গেছেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো। গুম-খুন, মামলা-হামলা আর গণহত্যাতো ছিলোই। ভেঙ্গে যাওয়া প্রশাসন এবং প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থেকে যাওয়া হাসিনার দোসররা একের পর এক সঙ্কট সৃষ্টি করে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর লাঠিয়াল ছাত্রলীগ-যুবলীগ আপাত: আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হলেও তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাঠে নামে বিভিন্ন সেক্টরের লোকজন। দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অফিস-আদালত-রাজপথে সৃষ্টি করে নৈরাজ্য। সরকারের প্রথম ৬ মাসে ১৮১টি আন্দোলন হয়। সরকার শপথ নেয় ৮ আগস্ট। আর ১৯ আগস্ট এক দিনে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের মোড়ে বিক্ষোভ করে অন্তত: ১৭টি সংগঠন। দাবি-দাওয়া দূরে থাক, হাসিনা আমলে যারা ‘টুঁ’ শব্দটি করেনি-তারাও নেমে আসে রাজপথে। অবশ্য দেশবাসীর বুঝতে সময় লাগেনি যে, এই নৈরাজ্য ছিলো পরিকল্পিত। বিতাড়িত হাসিনার ইন্ধনে। সরকারের উদার, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মানসিকতাকে পরাজিত শক্তি বেছে নিয়েছিলো ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মওকা হিসেবে। জুডিশিয়াল ক্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যু, গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা, পাহাড়ে অশান্তি, আনসার লীগ, ব্যাটারিচালিত রিকশা লীগ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থী, গার্মেন্ট শ্রমিক, এমএলএসএস থেকে শুরু করে প্রশাসন ক্যাডারের অবয়বেও চেষ্টা চলে ড.ইউনূস সরকারকে ‘ব্যর্থ’ প্রমাণের। পাশাপাশি ক্ষমতা হারানোর বেদনা থেকে সুতীব্র হুঙ্কারে যুগপৎ উন্মত্ততায় মেতে ওঠে পলাতক দিল্লিদাসী হাসিনা, তাকে আশ্রয় দেয়া ভারত, শাসক দল বিজেপি, বিরোধী দল কংগ্রেস, সেদেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং তাদের দোসর ঢাকার কিছু মিডিয়া। রাষ্ট্রদ্রোহী ইসকন নেতা চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার এবং ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ ইস্যু বানিয়ে বিরামহীন প্রপাগান্ডা চলে। চলে সাম্প্রদায়িক উস্কানি। যদিও দেশের ভেতরটায় চিত্র ছিলো ভিন্ন। দুর্গাপূজার মন্ডপ পাহারার দায়িত্ব নেয় বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং ধর্মপ্রাণ মানুষ। ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সঙ্গে সেটি মোকাবেলা করে। কোনো উস্কানির ফাঁদে পা দেয়নি। তবে উস্কানি এখনো অব্যাহত।

নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ৮ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকার নানামুখী সংস্কারে হাত দিয়েছে। সফলতায় পূর্ণ হতে চলেছে অর্জনের ঝুড়ি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের লাগাম টানা হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। অর্থ পাচারও বন্ধ প্রায়। বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গঠন করে অন্তত: ৬টি সংস্কার কমিশন। ইতিমধ্যেই কমিশনগুলো রিপোর্ট পেশ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নিয়োগ বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিচারপতি অপসারণে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ পুনর্জীবিত করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পুনর্গঠন, ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, হত্যা ও আয়নাঘরে বন্দীর ঘটনা তদন্তে ‘গুম কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। বিডিআর পিলখানায় সেনা হত্যার রহস্য উদঘাটনে ‘স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ কাজ করছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে ব্যবহার করে সিভিল ব্যুরোক্রেসি, পুলিশ এবং বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে হাজার হাজার মামলা দেয়। গায়েবি মামলা করে। এসব মামলায় আসামি করে অন্তত: ৪৫ লাখ বিরোধী রাজনীতিক নেতা-কর্মীকে। মানুষের বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধে প্রণয়ন করে ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’। এ আইনে হাজার হাজার মামলা দেয়া হয়। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রতিশ্রুতি। আ’লীগ সরকার ১৬ হাজার ৪২৯টি গায়েবি মামলা করে। গত ১৬ মার্চের তথ্য অনুযায়ী রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় ৬ হাজার ২০২টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে বহু মামলা এখনো প্রত্যাহার বা বাতিল হয়নি। ‘জঙ্গি তৎপরতা’র অভিযোগে হাসিনা বহু আলেমকে কারগারে পোরে। এখনো অনেক আলেম কারামুক্ত হননি। সাইবার সিকিউরিটি আইনে শত শত মামলা দেয়া হয়। সরকার বাদী হয়ে করা মামলার মধ্যে ৩৩২টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’র পূর্বতন না ছিলো ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন’ (আইসিটি অ্যাক্ট) এবং ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’। এসব আইনে ২০১৯ সালের আগে দায়েরকৃত মামলায় এখনো ‘অভিযুক্তরা’ হাজিরা দিয়ে চলেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আড়াই মাস পর গত ১৪ অক্টোবর পুনর্গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ও আওয়ামী শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে আ’লীগ প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনাল সচল করা হয়। ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য এ পর্যন্ত ৩শ’টির মতো অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার দফতরে জমা পড়েছে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের অনুমতিক্রমে ২৩টি অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্তাধীন অন্তত: ৩টি মামলায় আসামি হিসেবে রয়েছেন শেখ হাসিনা। মানবতাবিরোধী অপরাধের এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারির। অভ্যুত্থানকালে সাভারের আশুলিয়ায় সংঘটিত হত্যাকা- এবং হত্যার পর শহীদদের লাশ পোড়ানো মামলার চার্জশিট ট্রাইব্যুনালে দাখিল হবে যে কোনো দিন।

স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ইউনূস সরকারের চেষ্টাও লক্ষণীয়। হাসিনার অনুগত প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে। অপসারণ করা হয়েছে হাইকোর্ট বিভাগের বেশ কয়েকজন বিতর্কিত বিচারককে। নিয়োগ দেয়া হয়েছে নতুন ২৩ অতিরিক্ত বিচারপতি। স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতি ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়ন করছে সরকার। পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা দ্বারপ্রান্তে। বিচারক নিয়োগের লক্ষ্যে ‘সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করা হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি।

হাসিনার দেড় দশকের দুঃশাসনকালের দুর্নীতি নিয়ে গত ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্র প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তাতে উল্লেখ করা হয় প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এ হিসেবে ১৫ বছরে মোট পাচার হয়েছে ২শ’৪০ বিলিয়ন বা দুই লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সরকার ৯ টি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স পুনঃগঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ববোর্ড (এনবিআর), পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, আইন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। যৌথ টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর। ৮ মাস অতিবাহিত হলেও এ টাস্কফোর্স পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রশ্নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। এস.আলম,সামিট গ্রুপ,ওরিয়ন গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো, জেমকন, নাসা, নাবিল গ্রুপ,আরামিট গ্রুপের মালিকদের বিরুদ্ধে এককভাবে দুদক কিছু অনুসন্ধান শুরু করেছে। হাসিনার ৪টি সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী নেতার অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে কিছু মামলা হয়েছে। কিন্তু হাসিনা আমলে সংঘটিত কুইক রেন্টাল ও মোদীর বন্ধু আদানীকে খুশি করতে বিদ্যুৎ খাতের বিপুল দুর্নীতি, হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির কোনো মামলা হয়নি। অবশ্য ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা এবং তার পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রথম চার্জশিটটি দিচ্ছে দুদক। ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে ৬০ কাঠার প্লট হাতিয়ে নেয়ার মামলাটির চার্জশিট দুদক অনুমোদন দেয় গত ১১ মার্চ। এতে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক,আজমিনা সিদ্দিকসহ ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

দিল্লির প্রতি অনুগত নতজানু নীতির কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোকেও ধ্বংস করেন শেখ হাসিনা। ভারতের নিঃশর্ত গোলামী ছাড়া দেড় দশকে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। ভারতের সঙ্গে পেয়েছে ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক। এ হেন নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বিপরীতে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস কূটনৈতিক সাফল্যের দিক থেকে ৮ মাসে দেশকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কারাগার থেকে মুক্ত করেন ১৮৬ প্রবাসীকে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে সেখানে সংহতি প্রকাশ করে হাসিনার বিরুদ্ধে মিছিল করেছিলেন তারা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বক্তৃতা করেন জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে। এ সময় তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, নেপালের সরকার প্রধান, পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠকে অংশ নেয়া প্রতিটি পক্ষই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দায়িত্ব গ্রহণকে স্বাগত জানায়। তারা বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত মার্চ মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনি গুতেরেসের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যার্পণ উদ্যোগের জানান দেন। পরপরই ২৭ মার্চ চীন সফরে যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভারতের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য পোষণের প্রতিক্রিায় ক্ষমতা ছাড়ার কয়েক দিন আগে চীন থেকে রীতিমতো প্রত্যাখ্যাত, অপমানিত হন শেখ হাসিনা। বিপরীতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেন লাল গালিচা সংবর্ধনা। তাকে নেয়ার জন্য বিশেষ বিমান পাঠায় চীন। শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, নদী ব্যবস্থাপনা ও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা হয়। ঋণ এবং বিনিয়োগ বিভিন্ন ফরম্যাটে সোয়া ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পান ড.মুহাম্মদ ইউনূস। যদিও তার এ সফরকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি মোদীর ভারত। তবে এই অভূত সফর ও কূটনৈতিক সাফল্যে ড. ইউনূস নিজ দেশে ঠাঁই করে নিয়েছেন মানুষের মণিকোঠায়।

সেখান থেকে এসেই ৪ এপ্রিল ইউনূস যোগ দেন থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ‘বিমসটেক’ সম্মেলনে। সেখানে মিয়ানমার সামরিক জান্তা সরকার প্রধানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। বৈঠক হয় থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভুটানসহ পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে। এর পরই প্রথম দফায় অন্তত: ২ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রত্যর্পণের সম্মতির কথা জানা যায়। বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও। যদিও ভারত নানা অজুহাতে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাতকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রায় ৪০ মিনিটের বৈঠকে মোদীর সঙ্গে কথা হয় হাসিনাকে দেশে প্রত্যর্পণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং গঙ্গা-তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বিষয়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী দূরের কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা হাসিনা কোনোদিন উচ্চারণ করার সাহস দেখাননি- সেই কথা ড. ইউনূস বলেছেন নরেন্দ্র মোদীর চোখে চোখ রেখে। কয়েক মাসের কূটনৈতিক সাফল্য দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জয় করেছেন মানুষের হৃদয়। নির্মোহ এবং আইকনিক নেতৃত্বের কারণে ‘স্টেটম্যান’ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন অনন্য উচ্চতায়। হাসিনা পালানোর পর বাংলাদেশে যেন হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে।

সাতশ’ বছর আগে জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলিনের মানুষ ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ইঁদুরের অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলছিল। কোনো উপায়ন্তর না দেখে হ্যামিলিন শহরের মেয়রের নেতৃত্বে সবাই মিলে একজোট হয়ে ঠিক করেন, শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে যে বাঁচাতে পারবে তাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে এসে হাজির হলো রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা। সে জানাল তার বাঁশির সুরে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করা সম্ভব। শুনে সবাই অবাক; কিন্তু নিরুপায় হ্যামিলিনবাসীর কিছুই করার ছিল না। বাঁশিওয়ালাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কারের বিনিময়ে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করার আদেশ দেন। বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন বাঁশিওয়ালা। বাঁশির অদ্ভুত মায়াবী সুরের টানে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো সব ইঁদুর। একসময় ইঁদুরগুলোকে নিয়ে গিয়ে ওয়েজার নদীতে ফেলে দিলো বাঁশিওয়ালা। অবশ্য ইতিহাসে রয়েছে বাঁশিওয়ালার প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক না দেয়ায় কিছুদিন পর ওই বাঁশিওয়ালা নতুন করে বাঁশির সুরে শহরের সব শিশুদেরও সেভাবে নিয়ে যায়। ইতিহাসবিখ্যাত এ ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আবির্ভাব যেন হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক কিছু নিয়ে সন্দেহ এবং কয়েকজন উপদেষ্টার কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ওই বাঁশিওয়ালার মতোই যাদুকরি নেতৃত্বে দেশকে রক্ষা করছেন।

সর্বশেষ আপডেট: ৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০১
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও