মাহে রমজানের ২০তম তারাবিহ নামাজে সাধারণত কুরআন মাজিদের ২০তম পারা তেলাওয়াত করা হয়। এই পারাটি সূরা আন-নামল (২৭তম সূরা) এর ৫৯তম আয়াত থেকে শুরু হয়ে সূরা আল-কাসাস (২৮তম সূরা) এর শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পারার মূল বিষয়বস্তু এবং সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:
সূরা আন-নামল (২৭:৫৯-৯৩): এই অংশে আল্লাহর একত্ববাদ, নবীদের মিশন এবং পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর নিদর্শন ও সতর্কবাণী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
* হযরত সুলাইমান (আঃ) এবং রানী বিলকিসের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, যা আল্লাহর মহিমা এবং নবীদের মিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে।
* আল্লাহর নিদর্শন এবং সৃষ্টির মধ্যে তাঁর মহিমা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
সূরা আল-কাসাস (২৮:১-৮৮): এই সূরাটি হযরত মুসা (আ.) এর জীবনী এবং ফেরাউনের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে গঠিত।
* হযরত মুসা (আ.) এর জন্ম, ফেরাউনের অত্যাচার থেকে তাঁর রক্ষা, এবং মাদিয়ানে তাঁর জীবনযাপন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
* আল্লাহর সাহায্য এবং নবীদের প্রতি তাঁর সমর্থনের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
* সূরাটির শেষ অংশে আল্লাহর একত্ববাদ এবং কিয়ামতের দিনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
সারসংক্ষেপ: ২০তম পারায় আল্লাহর একত্ববাদ, নবীদের মিশন, এবং পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর নিদর্শন ও সতর্কবাণী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে হযরত সুলাইমান (আঃ) এবং হযরত মুসা (আঃ) এর কাহিনীগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর মহিমা এবং নবীদের প্রতি তাঁর সমর্থনের দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই পারাটি মুমিনদের জন্য আল্লাহর প্রতি আস্থা এবং ধৈর্য ধারণের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই পারা থেকে মানবজাতির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ ও শিক্ষা নিম্নরূপ:
১. পরীক্ষা ও ধৈর্যের গুরুত্ব: সুরা আল-আনকাবুতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন যে, মানুষকে পরীক্ষা করা হবে ঈমান ও আমলের মাধ্যমে। যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তারা সফলকাম হবে।
উপদেশ: জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখা ঈমানের অপরিহার্য অংশ।
২. মুশরিকদের যুক্তির অসারতা: এই পারায় মুশরিকদের যুক্তি ও তাদের মূর্তিপূজার অসারতা তুলে ধরা হয়েছে। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করে, কিন্তু তা সত্যের ভিত্তিতে নয়।
উপদেশ: অন্ধভাবে কোনো বিশ্বাস বা রীতিনীতি অনুসরণ না করে, বরং যুক্তি ও জ্ঞানের আলোকে সত্যকে গ্রহণ করা উচিত।
৩. আল্লাহর নিদর্শনসমূহ: সুরা আর-রুমে আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শনসমূহের কথা বলা হয়েছে। আকাশ, পৃথিবী, দিন-রাতের পরিবর্তন, মানুষের সৃষ্টি ইত্যাদি সবই আল্লাহর মহিমা ও ক্ষমতার প্রমাণ।
উপদেশ: আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শনসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
৪. আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়: সুরা আর-রুমে রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, যা আল্লাহর সাহায্য ও পরিকল্পনার প্রমাণ। আল্লাহর সাহায্য সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকে।
উপদেশ: সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং আল্লাহর সাহায্যের উপর আস্থা রাখা।
৫. দুনিয়ার জীবনের মোহ: এই পারায় দুনিয়ার জীবনের মোহ ও ক্ষণস্থায়ী সুখের কথা বলা হয়েছে। দুনিয়ার সম্পদ ও সুখ-সুবিধা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আখিরাতের জীবনই চিরস্থায়ী।
উপদেশ: দুনিয়ার জীবনের মোহে না পড়ে, আখিরাতের প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করা।
৬. তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা: আল্লাহ তা’আলা মানুষের তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
উপদেশ: গুনাহ থেকে তাওবা করা এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
৭. সৎকর্ম ও আল্লাহর স্মরণ: সৎকর্ম করা এবং আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকা ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর স্মরণই মানুষের হৃদয়কে প্রশান্ত করে।
উপদেশ: সর্বদা আল্লাহর স্মরণে থাকা এবং সৎকর্মে নিয়োজিত থাকা।
৮. আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা: এই পারায় আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা রয়েছে। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই।
উপদেশ: আল্লাহর একত্ববাদের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং শিরক থেকে দূরে থাকা।
৯. আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস: আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের অপরিহার্য অংশ। কিয়ামতের দিন সবাইকে তার আমলের হিসাব দিতে হবে।
উপদেশ: আখিরাতের প্রস্তুতি নেওয়া এবং আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার ভয় রাখা।
১০. ইসলামের বিজয় ও প্রসার: সুরা আর-রুমে ইসলামের বিজয় ও প্রসারের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আল্লাহর দ্বীন পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে।
উপদেশ: ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য কাজ করা।
এই পারা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা রাখা, ধৈর্য ধারণ করা, সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং আখিরাতের প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই শিক্ষাগুলো অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আমীন।
মাহে রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করা মুমিন মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতেকাফ হলো মসজিদে অবস্থান করে ইবাদত ও ধ্যানে নিমগ্ন হওয়া, যা বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে করা হয়। এর কিছু তাৎপর্য নিম্নরূপ:
১. লাইলাতুল কদর তালাশ : রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর (মহিমান্বিত রাত) পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই রাত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এতেকাফের মাধ্যমে মুমিনগণ এই মহান রাতের সন্ধান ও ইবাদতের সুযোগ পান।
২. আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি : এতেকাফের সময় মুমিনগণ দুনিয়াবি কাজকর্ম থেকে দূরে থেকে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যানে মগ্ন থাকেন। এটি আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য একটি অনন্য সুযোগ।
৩. আল্লাহর নৈকট্য লাভ : এতেকাফের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। মসজিদে অবস্থান করে ইবাদত ও জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
৪. সওয়াব ও মাগফিরাত লাভ : রমজান মাসে ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়। এতেকাফের মাধ্যমে মুমিনগণ অতিরিক্ত সওয়াব ও আল্লাহর ক্ষমা লাভের সুযোগ পান।
৫. নফল ইবাদতের গুরুত্ব : এতেকাফের সময় মুমিনগণ নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও অন্যান্য নফল ইবাদতের মাধ্যমে নিজেদের ইমানি শক্তি বৃদ্ধি করেন।
৬. সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা : এতেকাফের মাধ্যমে মুমিনগণ সাময়িকভাবে দুনিয়াবি কাজকর্ম ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হন। এটি আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি মাধ্যম।
সর্বোপরি, এতেকাফ মুমিন মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধি, ইমানি শক্তি বৃদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করার মাধ্যমে মুমিনগণ আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের আশা করেন।
সর্বশেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০০:৫৪
পাঠকের মন্তব্য