১৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : দেড় শতাধিক স্কুল-কলেজ : নাম দেখেই মিলেছে অনুমোদন, হয়েছে নীতিমালা লঙ্ঘন করে সরকারি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন সেই সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতা হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন, ব্যক্তিগত বাসভবন ধানমন্ডি-৩২ নাম্বারসহ সেই স্বৈরাচারের নিদর্শন তছনছ করে দিয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সকল মূর্তি। তবে এখনো দেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানে জ্বলজ্বল করছে স্বৈরাচার হাসিনা পরিবারের নাম। এর মধ্যে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজসহ প্রায় ২ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ ফজিলাতুন্নেছা, শেখ রাসেল, সায়েরা খাতুন, শেখ রেহানাসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে। তার পরিবারের কারো নাম থাকলেই দেয়া হয়েছে অনুমোদন, করা হয়েছে সরকারিও। নিয়ম ভেঙে মুজিব পরিবারের নামে গত বছরও ২৮টি স্কুল-কলেজ করা হয়েছে সরকারি। আবার একই নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকায় চিহ্নিত করতেও বিপাকে পড়ছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আওয়ামী সরকারের পতনের পর তিন মাস অতিবাহিত হলেও এখনো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হয়নি। এর মধ্যে কেবল কয়েকটি মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ মুজিব ও তার পরিবারের নামে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামরকরণ করা হয়েছে। এর আগের মেয়াদে ১৯৯৮ সালে শেখ মুজিবের নামে আরো দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামরকরণ করা হয়। ৬টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ শেখ মুজিব ও তার পরিবারের নামে রয়েছে। ফলে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের নামে ১৫ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। এছাড়া দেড় শতাধিক স্কুল-কলেজ নামরকণ করা হয়েছে হাসিনা পরিবারের নামে। এর বাইরে মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেখ মুজিব-হাসিনা ও তার পরিবারের নামে নামকরণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে থাকা স্কুল-কলেজ জাতীয়করনেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। শুধুমাত্র গত বছর বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে ২৮ স্কুল-কলেজ সরকারি করা হয়। এসব স্কুল-কলেজে জাতীয়করনে কোনো নীতিমালা মানা হয়নি।
শিক্ষার্থীরা জানায়, একই নামে একই ধরনের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় তাদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, আগের নাম একই রয়েছে শেষে শুধু জেলার নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করতে হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ক্ষেত্রে সাধারণত কেউ জেলার নাম বলতে চায় না। যে কোনো অনুষ্ঠানে, চাকরি-বাকরি বা বিদেশে পড়ালেখার ক্ষেত্রে নাম নিয়ে প্রতিনিয়ত জটিলতায় পড়তে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার দাদি সায়েরা খাতুনের নামেও করা হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজ। ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজকে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ, গোপালগঞ্জ শেখ লুৎফর রহমান (হাসিনার দাদা) ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে গোপালগঞ্জ ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল, জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে জামালপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব থাকাকালে বলেন, একই নামে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নামকরণে আইনি কাঠামো ঠিক করতে একটি কমিটি হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে বা সুপারিশ করবে। আমরা তা পাওয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামকরনের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করবো।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি। এর বাইরে আরো ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের আইন পাস হয়েছে। মোট ৬১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫টিই শেখ মুজিব-হাসিনা ও তাঁর পরিবারের নামে। তবে ১৯৯৮ সালে রাজধানীর পিজি হাসপাতালের নাম পরিবর্তন হয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামরকণ করা হয়। একই বছর গাজীপুরে স্থাপিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১০); ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (২০১৩); গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (২০১৬); নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৮); জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৮); বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়. সিলেট (২০১৮); লালমনিরহাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৯); বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ (২০২১); শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা (২০২১); বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর (২০২২); বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁ (২০২৩) নামরকণ করা হয়। এছাড়া ২০২৩ সালে আইন পাস হওয়া দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শরীয়তরপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়নগঞ্জ।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর একশও বেশি স্কুল ও কলেজ রয়েছে। এরপরই শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে ১৭টি, শেখ রাসেলের নামে ১০টি, শেখ হাসিনার নামে ৯টি, শেখ রেহানার নামে একটি এবং তাদের পরিবারের নামে আরো বেশকিছু স্কুল-কলেজ রয়েছে। বেশকিছু কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও রয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য আগেই আইন পাস করতে হয়। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামেই ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাস হয়েছে। আর স্কুল-কলেজগুলো সাধারণত বেসরকারি উদ্যোগ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নাম দিয়েছে। এসবের অনেকগুলোই শুধুমাত্র নামকরনের জন্য জাতীয়করণও করা হয়েছে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরণ সরকারি সিদ্ধান্তে হয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আইন পাস হয়েছে। এখন সরকার যদি আমাদের কাছে এ ব্যাপারে মতামত চায় তাহলে পূর্ণ কমিশনে আলোচনা করে আমরা আমাদের মতামত জানাবো।’
সর্বশেষ আপডেট: ৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৮
পাঠকের মন্তব্য