জুলাই-আগস্ট গণহত্যা মামলায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একচ্ছত্র মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে ট্রাইব্যুনাল ব্যবহার করে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ চালিয়েছিল পুনর্গঠিত সেই ট্রাইব্যুনালই মসনদচ্যুত হাসিনার বিরুদ্ধে জারি করলো প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা।
বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ পরোয়ানা (অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট) জারি করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন, শফিউল আলম মাহমুদ এবং মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
একই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় সাবেক সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ হত্যাকাÐে জড়িত ৪৬ জনের বিরুদ্ধে। জুলাই-আগস্ট গণহত্যা তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়েরকৃত কোনো মামলায় এটিই প্রথম পরোয়ানা। পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরও এটি প্রথম পরোয়ানা। এর মধ্য দিয়ে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করে আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওয়ারেন্টভুক্ত ৪৬ জনের মধ্যে আপিল বিভাগের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং ‘সুশীল বুদ্ধিজীবী’ ড. জাফর ইকবালের নামও রয়েছে।
প্রথম কার্যদিবসে গতকাল ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পৃথক ২টি আবেদন করেন। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল উপরোক্ত আদেশ দেন। একটি মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি করা হয়। আরেকটি মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানার আদেশ দেন। আদেশ প্রদানকালে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম ও বি এম সুলতান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে আগামী ১৮ নভেম্বর। এ সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করে হাজির করতে বলা হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ দীর্ঘদিন ধরে অযতেœ পড়ে ছিল। চীফ প্রসিকিউটর নিয়োগ দানের পর ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তীকালিন সরকার। এখনো সংস্কার কার্যক্রম চলমান। এ কারণে পাশের একটি ভবনে অস্থায়ীভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। সকাল ১১টায় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারসহ অপর দুই সদস্য একসঙ্গে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করেন। ট্রাইব্যুনালের প্রথম কার্যদিবস উপলক্ষে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিয়োগ করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। সকাল ১১টা ২০ মিনিটে শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। তিনি টানা ৪০ মিনিট দেড় দশকের আওয়ামী দুঃশাসনের মানবতাবিরোধী অপরাধের নানা তথ্য তুলে ধরেন। এর মধ্যে ছিল আওয়ামী শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, শাপলা চত্বরে হত্যা, আয়নাঘর, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান। বাদ যায়নি দুর্নীতির চিত্রও।
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। আসামি দেশের একজন প্রভাবশালী নাগরিক। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেও এখনো প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আসামির লোকজন বিভিন্ন পজিশনে দায়িত্বে রয়েছেন। তাই আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মামলার তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করছি।
আবেদন উপস্থাপনের এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, রাষ্ট্রীয়ভাবে আসামির অবস্থান জানেন কি না? জবাবে চীফ প্রসিকিউটর বলেন, না। পরে ট্রাইব্যুনাল চীফ প্রসিকিউটরের আবেদন মঞ্জুর করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। আর ১৮ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে এ সময়ের মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করতে বলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশ-ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয়। এতে নারী, শিশু, ছাত্র, তরুণ-বৃদ্ধসহ নানা বয়সের মানুষের শত শত মানুষ নিহত হন। অঙ্গহানিসহ চোখ অন্ধ হয়ে যায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতার। আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নির্দেশে চালানো হয় দেশের ইতিহাসের বর্বরতম এ গণহত্যা। রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বর্বরতম দুঃশাসনের অবসান ঘটে। জনতার রোষে উৎখাত শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যান। আশ্রয় নেন তার দীর্ঘ স্বৈরশাসনের নেপথ্য বহির্শক্তি ভারতে। ছাত্র-জনতার রক্ত-ঋণে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থর্নীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বাধীন ‘অন্তর্বর্তীকালিন সরকার’। এ সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রতিশ্রæতি হচ্ছে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার দ্রæত বিচার। প্রতিশ্রæতি পূরণের অংশ হিসেবে গত ১৪ অক্টোবর পুনর্গঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’।
এ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত গুম, হত্যা, গণহত্যাসহ ৬০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের নেতা, হাসিনার স্তাবক সংবাদকর্মী, শেখ হাসিনার সমর্থক শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা রয়েছেন।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রধান আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, দু’টি আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তবে পরোয়ানাভুক্তদের মধ্যে কে কে রয়েছেন-তার সম্পূর্ণ নামের তালিকা প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে সবার নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
চীফ প্রসিকিউটর জানান, পরোয়ানাভুক্তদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক তথ্য ও স¤প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও ছোট বোন শেখ রেহানা।
রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক র্যাব ডিজি হারুন অর রশিদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম।
এর আগে গত ১৩ অক্টোবর চীফ প্রসিকিটির জানিয়েছিলেন, জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হবে। শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত: স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করতে ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ওই বছরের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রেক্ষিতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদÐ কার্যকর করে শেখ হাসিনার সরকার। মৃত্যুদÐ কার্যকর হওয়া ব্যক্তিরা হলেন, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মো: আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলী। এ ছাড়া জামায়াতের নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু হত্যাকাণ্ড দেয় এই ট্রাইব্যুনাল। বিচারিক প্রক্রিয়া চালু থাকতেই ইন্তেকাল করেন জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক বিএনপি নেতা আবদুল আলীম। বিচার চলমান অবস্থায় মোহাম্মদ কায়সারও ইন্তেকাল করেন। শেখ হাসিনার করা ওই বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিশেষ করে বাইরে থেকে লিখে দেয়া রায় ট্রাইব্যুনালে পাঠ, পক্ষপাতদুষ্ট ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত দুর্বলতা, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, বানোয়াট অভিযোগ, সাজানো সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ,সুখরঞ্জন বালি’র মতো সাক্ষীদের ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে তুলে নেয়া ইত্যাদি কারণে ওই ‘বিচার’ আন্তর্জাতিকভাবেও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। বিচারের নামে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করায় এটিকে শেখ হাসিনার ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ বলেও আখ্যায়িত হয়। ভারত এবং শেখ হাসিনার টার্গেটেড রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মৃত্যুদÐ কার্যকর হলে ঝিমিয়ে পড়ে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করা হয়। একটি ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকার্য চলছিলো। শেখ হাসিনার সরকারের করা ৩০টি মামলা এখনো ট্রাইব্যুনালে ‘বিচারাধীন’।
সর্বশেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৪
পাঠকের মন্তব্য