শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেন শিশির। ‘ক্ষুদ্র’র দম্ভ বোঝাতে কবি উচ্চারণ করেছিলেন এই চরণ। ভারতের নাচের পুতুল ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার প্রশ্নে বর্তমান সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা যেন কবিতার ‘শৈবাল’র মতো। ফ্যাসিস্ট সরকারের দেয়া মামলা প্রত্যাহারে কেউ ‘বিনীত নিবেদন এই যে,’ বলে আবেদন করবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত ‘প্রত্যাহার সংক্রান্ত কমিটি’ সেটি যাচাই-বাছাই করবে। ‘সন্তোষজনক’ বিবেচিত হলে দয়া পরবশ হয়ে সরকারবাহাদুর সেই মামলা প্রত্যাহার করবেন। একেকটি মামলা প্রত্যাহারের খবর ‘ব্রেকিং নিউজ’ হবে। ঢাক-ঢোল পেটানো সেই ফলাও প্রচার দেখে মানুষের মধ্যে ড. আসিফ নজরুলদের সরকার সম্পর্কে ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে। এমন প্রত্যাশা হয়তো বর্তমান সরকারের। আর এমন ভাবনা থেকেই হয়তো আবেদন না করায় প্রত্যাহার হয়নি হাসিনার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক মাহমুদুর রহমানের কোনো মামলা। একই ভাবনা থেকে হয়তো এখনো প্রত্যাহার হয়নি ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের আপসহীন কন্ঠস্বর দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা। মামলা থেকে মুক্তি মেলেনি পত্রিকাটির কারা নির্যাতিত সাংবাদিকদের। হাসিনার ভুয়া মামলায় আদালতে হাজির হয়ে জামিন ভিক্ষা চাইতে হয় বর্ষীয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমানকেও। পক্ষান্তরে মামলা প্রত্যাহার প্রশ্নে প্রথমেই আসিফ নজরুলদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘প্রভু রাষ্ট্র’র আশীর্বাদপুষ্ট দৈনিক পত্রিকার নারী সাংবাদিকের নাম। ‘রাজনীতিক নেতা’দের মামলা প্রত্যাহার বলতে বারবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি নিশ্চিত করেন যে, ‘মাহমুদুর রহমান’ নন- তিনি ‘মাহমুদুর রহমান মান্না’। তখনো মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কোনো কমিটি গঠিত হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘প্রথম কর্তব্য’ হিসেবে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহার করলেন উপরোক্ত ব্যক্তিদ্বয়সহ বেশ কিছু মামলা। অথচ শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত জিয়া পরিবারের কারো মামলাই প্রত্যাহার হয়নি। স্বৈরচার বিরোধী লড়াইয়ের আপসহীন নেত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হাসিনা এবং ভারতের মদদপুষ্ট ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সরকার দায়ের করে ৩৭টি মিথ্যা মামলা। যার ২টিতে তিনি সাজা ভোগ করছিলেন। রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ৭ বছরের সাজা মওকুফ করেন প্রেসিডেন্ট। মানহানির ৫টি মামলা থেকে অব্যাহতি পান স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়ায়। গ্যাটকো, নাইকোসহ আরো অন্তত: ৩০টি মামলায় বেগম খালেদা জিয়া এখনো আসামি। একইভাবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের হয় অর্ধশত মামলা। নিকট আগামীর সম্ভাব্য রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলাও প্রত্যাহারে অগ্রাধিকার পায়নি। বিচারের স্বাভাবিক নিয়মে তার ১৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ ২টি মামলায় তিনি ‘সাজাপ্রাপ্ত’। ফলে আগে ‘প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা’ এবং ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা’ দেখাতে তারেক রহমানকে প্রথমেই আত্মসমর্পণ করে কারাবরণের ‘আইনি পথ’ বাৎলে দিচ্ছেন কোনো কোনো আইনজীবী। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, হাসিনার আদালতে দেয়া ‘কারাদণ্ড’ সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে আইনগত অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। ১৯৫৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি (সংশোধনী)র ১০ (৪) ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলা প্রত্যাহার করে নেয় দায়েরকারী কর্তৃপক্ষ। এ জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে কোনো আবেদন দিতে হয়নি। স্বপ্রণোদিত হয়েই মামলা প্রত্যাহার করে দায়েরকারী প্রতিষ্ঠান। বলাচলে ম্যাজিকের মতোই ঘটে সেই ঘটনাটি। দণ্ডাদেশ বাতিল হয়ে যায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই। পক্ষান্তরে ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা’ প্রদর্শন করতে বলা হচ্ছে তারেক রহমানকে।
রাজনীতি থেকে বহুদূরে অবস্থান ছিলো নিরপরাধ গৃহিণী ডা: জোবায়দা রহমানের। কিন্তু জিয়া পরিবারের সদস্য এবং তারেক রহমানের স্ত্রী হওয়াটাকে ‘অপরাধ’ গণ্য হয় হাসিনার আইনের শাসনকালে। দুদককে দিয়ে মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে। বিনা অপরাধে তাকে কারাদণ্ড দেয় হাসিনার আদালত। এখন ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা’ দেখাতে হয়তো তাকেও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আগে কারাভোগের পরামর্শ দেবেন অনেক আইনজীবী। অথচ স্বৈরাচার হাসিনার পুরো শাসনটাই যদি অবৈধ হয়ে যায়, তার সময়ে দেয়া কথিত ‘দণ্ডাদেশ’ এবং ‘মামলা’ কি করে ‘বৈধ’ হতে পারেÑ এ প্রশ্ন করছেন না কোনো বিজ্ঞ আইনজীবী। আর এভাবেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার সশরীর উৎখাত হলেও আইনের ধারা-উপধারার ব্যাখ্যা চলছে হাসিনারই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
স্বৈরাচার হাসিনা উৎখাতে দেড় দশক যারা লাখ লাখ মিথ্যা মামলার আসামি হলেন, বিনা অপরাধে কারাভোগ করলেন,তাদের মামলা প্রত্যাহার কিংবা বাতিল করতে নাকি এখন পৃথক আবেদন করতে হবে। অথচ সরকার কিছু ক্যাটাগরি করে একটি আদেশের মাধ্যমে সব মামলা বাতিল কিংবা খারিজ করতে পারেন। যার যার মামলা তার প্রত্যাহারের জন্য পৃথক আবেদনের গ্লানি সইতে হয় না।
হাসিনা সরকার আমলে বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে লাখ লাখ। গায়েবি মামলা দেয়া হয়েছে শত শত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৭ সাল থেকে ৫ আগস্ট হাসিনা উৎখাত পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৪৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে। এ সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনা হত্যা করেছেন ১ হাজার ৫শ’ ৫১ জনকে। এর মধ্যে শুধু বিএনপি’র নেতা-কর্মী রয়েছেন ৮৩৭ জন। এ সময়ের মধ্যে গুম করা হয়েছে ১২০৪ জনকে। পরবর্তীতে আইনÑশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার দেখানো হয় ৭৮১ জনকে। চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলীসহ গুম করা হয়েছে বিএনপির ৪২৩ জনকে। এদের মধ্যে এখনো ৭২ জনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের শহীদ নেতা-কর্মীর সংখ্যা ১৫৭ জন। এককভাবে সর্বাধিক মামলার আসামি বিএনপি’র যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। হাসিনা সরকার তার বিরুদ্ধে ৫শ’রও বেশি মামলা দায়ের করে। রাজনীতিতে ‘ক্লিন ইমেজের লোক’ হিসেবে পরিচিত বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা শতাধিক। সিটি করপোরেশনের ময়লা গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলা পর্যন্ত রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দলটির স্থায়ী কমিটি গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে মামলা আছে ৫০টির মতো। আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে মামলা ৮০টি। সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রূহুল কবীর রিজভির বিরুদ্ধে মামলা ১৮০টির মতো। বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মীর সরাফত আলী সপুর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে গড়ে দেড় শতাধিক। যুবদলের সাইফুল আলম নীরব, জাহাঙ্গীর হোসেন, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু,ছাত্র দলের রাজীব আহসান, আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে গড়ে এক শ’র বেশি মামলা রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার মিথ্যা মামলার শিকার, এতে কি আইন উপদেষ্টার সন্দেহ রয়েছে ? তাহলে মামলা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রত্যাহার সংক্রান্ত কমিটি গঠন কেন? মামলা প্রত্যাহারের জন্য জনে জনে আবেদনই করতে হবে কেন ?
বিএনপি’র দলীয় সূত্রে জানাগেছে, দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। এসব ধারায় দায়েরকৃত মামলার শাস্তি ১৩ বছর কারাদণ্ড। বিএনপি’র নিজস্ব ওয়েবসাইট কিংবা বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের নাম লিখে গুগলে সার্চ দিলে মামলার সংখ্যা, মামলার ধারা, কথিত ‘অভিযোগ’ এবং বিচারের পর শাস্তির বিধান ভেসে ওঠে। আদালত এবং সরকারি নথিপত্রে এই সংগ্রামীদের নাম এখনো ‘অপরাধী’ হিসেবে লিপিবদ্ধ। সরকার পরিবর্তন হলেও নথি পরিবর্তন হয়নি। অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা কোনো দেশের অ্যাম্বাসিতে ভিসার জন্য দাঁড়ালে ভেসে উঠছে এসব তথ্য। তারা বিদেশ যেতে পারছেন না। ভিসা পেলেও ইমিগ্রেশনে পড়তে হচ্ছে মহা বিড়ম্বনায়। সরকার যদি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নথি ধরেই চলে, তাহলে হাসিনা রেজিমের সঙ্গে বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান পার্থক্য কোথায় ?
বিশ্লেষকদের প্রশ্ন এখন একটাই, হাসিনার রেখে যাওয়া আইন অনুসারেই যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে চায়, তাহলে এ সরকারের আইনি বৈধতা কে দেবে ? কোন্ সংবিধান আর কোন্ আইন মেনে এ সরকার দেশ পরিচালনা করছে? যাদের রক্ত এবং ত্যাগের বিনিময়ে আজকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই সরকার কেন বিপ্লবীদেরকেই হাইকোর্ট দেখাবে ? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হাইকোর্ট মোকাবেলা করেই যদি মামলা প্রত্যাহার করাতে হয়, নিকট ভবিষ্যতে অন্তর্বর্তী সরকারকেও হয়তো সুপ্রিমকোর্ট মোকাবেলা করতে হতে পারে।
ফৌজদারি আইনে অভিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মতে, মামলা প্রত্যাহার প্রশ্নে শেখ হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার আমলে কোনো আইনের শাসন ছিলো না। হাসিনার আকাক্সক্ষাই ছিলো আইন। তিনি যা চেয়েছেন তা-ই হয়েছে। হাসিনার অনুগত, দাসানুদাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছিলেন আইনি ব্যাখ্যা প্রদানের প্রধান মুসাবিদাকারক। গুরুতর অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশ চিকিৎসা প্রশ্নে মুচকি হেসে আনিসুল হক বলতেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার গায়েবি মামলা দিয়ে বলতেন, এতে সরকারের কোনো হাত নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় তাদের (বিরোধী নেতা-কর্মী) গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা প্রত্যাহার প্রশ্নে আনিসুল হকের গৎবাঁধা কথাই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করতে হবে- এমন মনোভাব প্রত্যাহার না করলেও বর্তমান সরকারকে হয়তো আরো বড় ধরনের আইনি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। সূত্র: ইনকিলাব
সর্বশেষ আপডেট: ১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২৪
পাঠকের মন্তব্য