শেখ হাসিনা প্রধানমস্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পটভূমিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, যা হাসিনার মেয়াদের মতো ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আর আবদ্ধ নয়। ভারতের আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইছে এবং তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ প্রতিফলিত করে এমন একটি পররাষ্ট্র নীতি তৈরি করতে চাইছে।
বাংলাদেশে এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তির পাকিস্তানের সাথে পারমাণবিক চুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান। তার এই প্রস্তাব পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার আলোচনায় বিশেষ গতি লাভ করেছে। এবং এই অঞ্চলে উত্তেজনা ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
ড. জামান বলেছেন, ‹পারমানকিকীকরণ; আমি বলতে চাচ্ছি যে আমাদের সাবেক প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক চুক্তি করতে হবে। জোট ছাড়া এবং প্রযুক্তি ছাড়া ভারত ভাল করতে পারবে না। ভারতকে এই ১৫ বছরের অভ্যাসগত বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে এটি বাংলাদেশকে ঠিক সেভেন সিস্টার্সের মতো একটিতে পরিণত করতে পারে।’
রবিবার ঢাকায় অবসরপ্রাপ্ত আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (আরএওডব্লএ) আয়োজিত একটি সভায় বক্তৃতাকালে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আগ্রাসন প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে ড. শহীদুজ্জামানের বলেন, ‘একটি পাকিস্তান-বাংলাদেশ জোট, বিশেষ করে পারমাণবিক প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে, এই অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করতে পারে।’
ড. শহীদুজ্জামানের দাবি, পাকিস্তান বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত নিরাপত্তা মিত্র, যা আঞ্চলিক জোট সম্পর্কে দীর্ঘকাল ধরে থাকা বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে এবং ভারতের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ঢাকায় ক্রমবর্ধমান আকাক্সক্ষাকে তুলে ধরে। তার মতে, ‘আমাদের পাকিস্তানের সাথে একটি পারমাণবিক চুক্তি করতে হবে, এটাই ভারতীয়রা আমাদের বিশ্বাস করতে দিতে চায় না।’
ড. জামান যুক্তি দিয়েছেন, পাকিস্তান তার প্রমাণিত পারমাণবিক সক্ষমতা এবং সামরিক শক্তির সাথে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হবে, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী ভারতের বিরুদ্ধে এবং ভারতের আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে পাকিস্তান সব কিছু করবে। তার মন্তব্যে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ভবিষ্যত এবং এতে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে জাতীয় আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা নিয়ে, বিশেষ করে হাসিনার প্রস্থানের পর দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান আবেগ প্রতিফলিত করে অধ্যাপক শহীদুজ্জামান বলেন, ‘পাকিস্তানের সাথে একটি পারমাণবিক চুক্তি বাংলাদেশকে কৌশলগত গভীরতা প্রদান করতে পারে, যা এটি তার বৃহত্তর প্রতিবেশীর কাছ থেকে যে কোনও হুমকি প্রতিরোধ করবে। এ ধরনের চুক্তি শুধু বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাই শক্তিশালী করবে না বরং আঞ্চলিক শক্তির রূপরেখাও বদলে দেবে।’
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশকে প্রায়শই ভারতের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত দেখা গেছে, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, যদিও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে এই ঘনিষ্ঠতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে, বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন যে, সীমান্ত চুক্তি থেকে সামরিক মহড়া পর্যন্ত ভারতের কৌশলগত স্বার্থের পক্ষে বাংলাদেশ তার স্বায়ত্তশাসন হারাচ্ছে।
হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের নীতিগুলির বেশিরভাগই নয়াদিল্লির লক্ষ্যগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির সাথে সাথে বাংলাদেশ তার আঞ্চলিক জোটের পুনর্মূল্যায়ন এবং নিজস্ব জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের সাথে পারমাণবিক চুক্তির জন্য ড. জামানের আহ্বান এমন সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশ তার নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করতে চাইছে।
পাকিস্তানের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতকে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাবে যে, এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে তারা আর নিস্ক্রিয় খেলোয়াড় হতে ইচ্ছুক নয়। একটি পারমাণবিক চুক্তি বাংলাদেশকে একটি নিরাপত্তা ছাতা প্রদান করবে, যা পাকিস্তান চীনের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উপভোগ করে। এটি নয়াদিল্লির সাথে লেনদেনে ঢাকাকে আরও বেশি সুবিধা দেবে।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নতুন করে অংশীদারিত্বের দরজা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি ইসলামাবাদের ধারাবাহিক সমর্থন এবং এর শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পেক্ষাপটে পাকিস্তানকে ঢাকার জন্য একটি প্রাকৃতিক সহযোগী হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
পাকিস্তানের জন্য, বাংলাদেশের সাথে একটি পারমাণবিক চুক্তি শুধুমাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে তার ভূমিকাকে দৃঢ়ই করবে না, পাশাপাশি, দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাবকেও শক্তিশালী করবে। পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তি এবং চীন এবং তুরস্কের সাথে তার কৌশলগত অংশীদারিত্ব তাকে বাংলাদেশের জন্য একটি আদর্শ অংশীদার হওয়ার দাবিদার করে তুলেছে। কারণ এটি বাংলাদেশ এখন প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।
এছাড়া, অতীতের বিরোধ সত্ত্বেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার পূর্বের অভিন্ন ইতিহাস নিরাপত্তা জোট গঠনের একটি ভিত্তি প্রদান করে। কারণ উভয় দেশই ভারতের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনে বিরুদ্ধে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। একটি পারমাণবিক চুক্তি তাদের অংশীদারিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং ক্রমবর্ধমান অস্থির অঞ্চলে পারস্পরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
পাকিস্তানকে একটি নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত মিত্র হিসাবে, বাংলাদেশের প্রতি যেকোন বাহ্যিক হুমকি, বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। একটি পারমাণবিক চুক্তির উন্নয়ন বাংলাদেশকে কৌশলগত গভীরতা প্রদান করবে, যা পররপাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে তার স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার সময় একটি জটিল আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট মূল্যায়ণ করার সুযোগ দেবে। ঠিক এটাই ভারতের ভয়।
পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি শক্তিশালী পাকিস্তান-বাংলাদেশ জোট দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং বাংলাদেশকে তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেবে, নয়াদিল্লির নির্দেশে নয়। বাংলাদেশের এই নতুন যুগে, দেশ তার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রস্তুত এবং অবিচল অংশীদার হিসেবে পাকিস্তান তার পাশে দাঁড়িয়েছে। সূত্র: ইন শট।
সর্বশেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫২
পাঠকের মন্তব্য