অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের প্রকল্পগুলো কখনোই দেশের মানুষের জন্য ছিল না, বরং এর সঙ্গে জড়িত ছিল কুৎসিত আমিত্ব এবং বিশাল আকারের চুরি।
তিনি বলেন, আমরা চাই আমাদের দেশ যেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে সম্মানের সঙ্গে পরিচিত হয়। দেশের পরিকল্পনা যেন দেশের মানুষকেন্দ্রিক হয়, কোনো নেতা বা দলকেন্দ্রিক নয়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক মাসপূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যের শুরুতে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সকল শহীদদের কথা। তিনি বলেন, গণ-অভ্যুথানে সকল শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। সকল আহত শিক্ষার্থী শ্রমিক জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত মাসে কুমিল্লা-নোয়াখালী সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা এসব এলাকার মানুষকে হতভম্ব করে দিয়েছে। দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে বন্যা আক্রান্ত সবাইকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে। সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনী পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে একযোগে কাজে নেমে পড়ার ফলে মানুষের দুর্ভোগ কম হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় সহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে সকলের শেষ ভরসার স্থান। দেশ গঠনেও আপনারা সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। বিগত জুলাই হতে শুরু হওয়া গণ অভ্যুত্থান, বন্যা, নিরাপত্তা প্রদান, অস্ত্র উদ্ধার সহ সকল কার্যক্রমে আপনারা সফল ভাবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আসি আপনাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বন্যার পরে পুনর্বাসনের কঠিন কাজে সকলের সহযেগিতায় আশা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা উন্নতির জন্য আমরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কর্মসূচি দিয়ে আপনারা জনগণের যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না। আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের ন্যায্য আবেদনের কথা ভুলে যাবো না। আমরা সকল অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তৈরি পোষাক, ঔষধ শিল্পের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এমনিতেই ছাত্র-শ্রমিক জনতার বিপ্লবের পর যে অর্থনীতি আমরা পেয়েছি সেটা নিয়ম নীতিবিহীন দ্রুত ক্ষীয়মাণ একটা অর্থনীতি। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। আমরা এই অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করছি। আমাদের উদ্যোগে সাড়াও পাচ্ছি। ঠিক এই সময়ে আমাদের শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে, অকার্যকর হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত পড়বে। সেটা কিছুতেই কারো কাম্য হতে পারে না। তিনি মালিক শ্রমিকদের ধৈর্য্যশীল হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখুন। দেশের অর্থনীতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিন। তিনি বলেন, সব কিছুই সম্ভব যদি আমরা শ্রমিক মালিক সম্পর্কটা একটা নির্ভরযোগ্য, আনন্দদায়ক করে গড়ে তুলতে পারি।
ড. ইউনূস বলেন, দেশের নতুন প্রজন্ম নির্ভয়ে যেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য একসাথে অনেকগুলো কাজে আমাদের হাত দিতে হবে। পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনকে দমন করতে যে-সব ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছিল এর মধ্যে হত্যা মামলা ছাড়া বাকী প্রায় সকল মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতারকৃত সকলে মুক্তি পেয়েছেন।
বিচার বিভাগের বড় সংস্কারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যোগ্যতম ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়াতে মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগসহ অনেকগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ এবং অন্যান্য নিয়োগ সবকটাই সম্পন্ন হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন ও ডিজিটাল/সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ বাংলাদেশে বিদ্যমান সকল কালো আইনের তালিকা করা হয়েছে। অতি সত্বর এ সকল কালো আইন বাতিল ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ বহুল আলোচিত ৫টি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা বলপূর্বক গুম থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সনদে স্বাক্ষর করেছি। ফলে স্বৈরাচার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ্রগুম সংস্কৃতিগ্ধ-র সমাপ্তি ঘটানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। এছাড়া আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য পৃথক একটি কমিশন গঠন করছি। আয়না ঘরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাখাতে সংস্কারের কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতে যেন উজ্জ্বল হয় সেটা নিশ্চিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে আমাদের পূর্ণ নজর রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। বই সংশোধন এবং পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উচ্চ প্রশাসনিক পদগুলো পূরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ডে দখলদারিত্বের রাজনীতি বন্ধ করার ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। প্রথম মাসে আমরা ক্রমাগতভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন ভিসি এবং প্রো-ভিসি নিয়োগ দেয়ার কাজ শুরু করেছি। এর ফলে সকল সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধা বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন।
ড. ইউনূস বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান টেলিফোনে এবং শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনার বৃন্দ আমার সাথে সাক্ষাৎ করে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার অনুরোধে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫৭ জন বাংলাদেশি যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন সে দেশের সরকার। ইতোমধ্যে তাদের কয়েকজন দেশে ফিরে এসেছেন। এই ক্ষমা প্রদর্শন ছিল অতি বিরল একটি ঘটনা। এজন্য আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান কে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি আপনাদের সবার পক্ষ থেকে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা ভারত এবং অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। তবে সেই সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে। ভারতের সাথে আমরা ইতিমধ্যে বন্যা মোকাবেলায় উচ্চপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আলোচনা শুরু করেছি । দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমি সার্ক রাষ্ট্র গোষ্ঠী পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা চাই আমাদের দেশ যেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে সম্মানের সাথে পরিচিত হয়।
সর্বশেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪০
পাঠকের মন্তব্য