দেশের ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে সচিবালয়ে উপসচিব পর্যায়ের একদল বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা হট্টগোল করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব কেএম আলী আযমের কক্ষে হট্টগোল করেন বিক্ষুব্ধ উপসচিবরা। এ সময় কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। ডিসি পোস্টিংয়ের জন্য গঠিত এসএসবি বোর্ডের সদস্য সচিব জয়েন্ট সেক্রেটারি আলী আজমকে লাঞ্ছিত করেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। এ নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা। জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগের দুইটি আদেশ বাতিল করতে যাচ্ছে অন্তর্বতী সরকার। যাদের পদায়ন করা হয়েছে তাদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এমন সমালোচনার মুখে এ সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আলী আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিয়োগ প্রত্যাশী বঞ্চিত কর্মকর্তারা। পরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন আলী আযম। এ সময় বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেন, নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট। তাই এ দু’টি প্রজ্ঞাপন বাতিল করে মেধা, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে নতুন করে জেলা প্রশাসক পদায়ন করতে হবে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সবাইকে আশ্বস্ত করেন। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলবেন এবং এ দু’টি আদেশ বাতিলের ব্যবস্থা করবেন। ডিসি পদ প্রত্যাশী একজন উপসচিব ইনকিলাবকে বলেন, ছাত্র জনতার আন্দোলনে যে বৈষম্য বিরোধী ব্যবস্থা গড়ে উঠার কথা ছিলো তা এই ডিসি নিয়োগে প্রতিফলিত হয়নি। যাদের ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এদের নিয়োগের মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বতী সরকারের চেষ্টা ব্যর্থ হবে।
গতকাল ৩৪ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে সোমবার ২৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। গতকাল দুপুরে ৩৪ জেলায় ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর বঞ্চিত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ভিড় করতে থাকেন। ভিড় করা এই কর্মকর্তারা মূলত বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত যারা আওয়ামী লীগের আমলে পদায়ন-পদোন্নতির ক্ষেত্রে বঞ্চিত ছিলেন। বঞ্চিত কর্মকর্তারা দাবি করেন, যাদের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। গত সরকারের অনুগত থাকায় তারা ভালো জায়গায় চাকরি করেছেন। ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিল চেয়ে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের যুগ্মসচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও কে এম আলী আযমের কক্ষে যান। সম্প্রতি তাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পদায়ন করা হয়েছে। বঞ্চিত কর্মকর্তারা তাদের কাছে জানতে চান, তারা থাকতে কীভাবে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা ডিসি নিয়োগ পেল? জবাবে তারা জানান, মূলত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ তালিকা চূড়ান্ত করেছে।
তখন উপস্থিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই দুই যুগ্ম সচিবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। পরে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ওই দুই যুগ্ম সচিবসহ ২৫-৩০ জন কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কক্ষে প্রবেশ করেন। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে তারা বের হয়ে আসেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কক্ষ থেকে বের হওয়া কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানিয়েছি। কেন বাতিল করতে হবে সেটাও তুলে ধরেছি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, তিনি আমাদের দাবি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের কাছে তুলে ধরবেন। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিব পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। ডিসি নিয়োগ পাওয়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে বঞ্চিতরা বলেন, তাদের কয়েকজনের শেয়ারবাজারে মোটা অংকের বিনিয়োগ, সহকর্মীকে হেনস্তা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, সাবেক মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল।তারা দীর্ঘদিন জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। আবার এখন নতুন করে পেলেন হিসেবে ডিসি নিয়োগ। যারা ডিসি নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অনেকের নাম দিয়েছেন তানভীর নামে একজন সমন্বয়ক। তাকে ইদানিং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা। ডিসি ফিটলিস্ট করার সময় বলা হয় মাঠ প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), ইউএনও, এসিল্যান্ড পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু ডিসি নিয়োগ পেয়েছেন এমন অনেকের মাঠ প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই বলে দাবি করেন প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের একজন উপসচিব। আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের সময় আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আমরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করবো বলে আমাদের মাঠ প্রশাসনে পদায়ন করা হয়নি। ডিসি হতে পারিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও আমরা পেলাম আরও বড় বঞ্চনা। সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। জেলা পর্যায়ে ডিসি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসি জেলার সাধারণ প্রশাসনিক কার্যক্রম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং কালেক্টর হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো দেখে থাকেন। এছাড়া নির্বাচিত সরকারের বিশেষ কর্মসূচি এবং চলমান সব উন্নয়নমূলক কাজে জেলা প্রশাসক তদারক করেন।
৩৪ জেলার মধ্যে ভূমি সংস্কার বোর্ডের উপ-ভূমি সংস্কার কমিশনার নুসরাত সুলতানাকে কুড়িগ্রাম, অর্থ বিভাগের উপসচিব ড. মনোয়ার মোল্লাকে মানিকগঞ্জ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. সাবেত আলীকে টাঙ্গাইল, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদারকে সিরাজগঞ্জ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তোষাখানা ইউনিট পরিচালক মোস্তাক আহমেদকে সাতক্ষীরা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশরাফুর রহমানকে ঝালকাঠি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খানকে পিরোজপুর, বেসামরিক বিমান পরিবহন ওপর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিবমোহাম্মদ জহিরুল ইসলামকে চুয়াডাঙ্গা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব বনানী বিশ্বাসকে নেত্রকোনা, আরপিএটিসি উপপরিচালক মনোয়ারা বেগমকে রাজবাড়ী, ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ের উপ ওয়াকফর প্রশাসক হাছিনা বেগমকে জামালপুর জেলায় পদায়ন করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আব্দুস সামাদকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ভিভাগের সুফিয়া আক্তার রুমীকে লক্ষ্মীপুর, জয়িতা ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোছা. ইয়াসমিন আক্তারকে মাদারীপুর, জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব ফৌজিয়া খানকে কিশোরগঞ্জ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহবুবুর রহমানকে রাজশাহী, নিউরো ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের পরিচালক মোহাম্মদ দিদারুল আলমকে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া, পরিকল্পনা বিভাগের উপসচিব ফাতেমাতুল জান্নাতকে মুন্সীগঞ্জ, স্বাস্ত্যসেবা বিভাগের উপসচিব মো. আব্দুল আজিজকে শরীয়তপুর, অর্থ বিভাগের উপসচিব আহমেদ কামরুল হাসানকে বাগেরহাট, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিরীক্ষা কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনকে পটুয়াখালী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াকে সুনামগঞ্জ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যভস্থাপনা বিভাগের উপসচিব মো. আজাদ জাহানকে ভোলা, খুলনা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক সিফাত মেহনাজকে মেহেরপুর, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামানকে পঞ্চগড়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজহারুল ইসলামকে যশোর, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমকে বরগুনা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানকে নড়াইল, সেতু বিভাগের উপসচিব শরিফা হককে নীলফামারী, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক এইচ এম রকিব হায়দারকে লালমনিরহাট জেলার ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. দেলোয়ার হোসেনকে বরিশাল, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইশরাত ফারজানাকে ঠাকুরগাঁও, জননিরাপত্তা বিভাগের উপ সচিব মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরীকে নরসিংদী এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মোবাশশেরুল ইসলামকে দিনাজপুরের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্র্বতী সরকার গঠন হলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার শুরু হয়। গত ২০ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৫ ডিসিকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ওই দিন এক আদেশে ঢাকা, সিলেট, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মাগুরা, রংপুর, গাইবান্ধা, নওগাঁ, নাটোর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, গাজীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, খুলনা, গোপালগঞ্জ জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পৃথক আদেশে, ফরিদপুর, শেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, চাঁদপুর জেলার ডিসি প্রত্যাহার করা হয়।
সর্বশেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৭
পাঠকের মন্তব্য