যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ! রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা রেজিমকে পরাজিত করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের ভাষায় দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন। আওয়ামী লীগ শাসনামলের ১৫ বছর দেশের ধন-সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে টাকা পাচারের মহোৎসহ হয়েছে। ডলার সংকট, রিজার্ভ তলানিতে, ব্যাংকিং সেক্টরকে ধ্বংস, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবসায়ীদের দিয়ে সিন্ডিকেট করে গোটা শিল্প-বাণিজ্য সেক্টরকে কিছু মানুষরুপী লুটেরার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎ সেক্টরে ভয়াবহ লুট হয়েছে; অথচ গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে মিলকারখানার চাকার গতি হয়েছে মন্থর। ব্যাংকিং সেক্টরে হয়েছে ভয়াবহ লুটপাট। এমনকি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীকে ‘দানবে’ পরিণত করে রাজপথে রক্ত ঝড়িয়েছে। চোখ হারিয়েছে এবং পঙ্গু হয়েছে হাজারো ছাত্রজনতা। অসংখ্যা ছাত্র জনতাকে গুলি করে হত্যা এবং অবকাঠামোর ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও পরিবহন খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। হুহু করে বেকারত্ব বেড়েছে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দেশ পুনর্গঠন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। এর মধ্যে সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দিল্লিতে বসে পতিত হাসিনা সংখ্যালঘু নির্যাতন, জুডিশিয়াল ক্যু, ১৫ আগস্টে ঢাকা দখল, আনছারদের দিয়ে সচিবালয় ঘোড়াও অনেকগুলো অপকাণ্ড ঘটানোর চেস্টা করেছে। এমনকি সরকারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, কর্পোরেশনে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা দাবি আদায়ের নামে বিশৃংখলা করার অপচেষ্টা করছে। এ সবকিছু হচ্ছে দিল্লিতে পালানো শেখ হাসিনার আঙ্গুলের ইশারায়। সিভিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, র্যাব, বিজিবি এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এখনো পতিত হাসিনার দলীয় বিবেচনায় নিয়োগকৃতরা সক্রিয় রয়েছেন। ‘শর্ষের ভিতরে ভুত’ আমলাদের সহায়তায় বিশৃংখলা সৃষ্টির অপচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। অন্যদিকে শুরু হয়েছে দখলদারিত্ব।এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে সরকার কঠোর হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, সরকার কঠোর না হলে হাসিনার পাল্টা ক্যূর অপচেস্টা অব্যহত থাকবে। আর অর্থনৈতিক ভাবে খাদের কিনারে যাওয়া দেশ পুনর্গঠনে সরকারকে সময় দিতে হবে।
৮ আগস্ট ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। নতুন সরকার পথচলা শুরুর পর গত তিন সাপ্তাহে মোদীর মদতে দিল্লিতে বসে হাসিনা কয়েকদফায় প্রতিবিপ্লবের অপচেস্টা করেন। সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনের আমলাদের মধ্যে বড় একটা অংশ এখনো পতিত হাসিনার গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করছেন। আইন শৃংখলা বাহিনীর বড় একটা অংশ যারা দানবীয় কায়দায় গুলি করে শত শত ছাত্রজনতা হত্যা করেছে তারা এখনো কাজে যোগ দেয়নি। ফলে এখনো আইন শংখলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশের একটা বড় অংশ কাজে যোগদান করলেও স্বাভাবিক কাজকর্মের বাইরে অন্যান্য কাজ করছেন না। রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। যারা কাজে যোগদান করেছেন তারা ‘চাঁদাবাজী’ না থাকায় কাজে আগ্রহ পাচ্ছেন না। তাছাড়া প্রকাশ্যে কয়েকশ ছাত্র জনতা হত্যা করায় তারা পাল্টা আক্রমণের ভয় এবং মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। নতুন সরকার এরোই মধ্যে প্রশাসন পুনর্গঠনে হাত দিয়েছেন। প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল, বদলি, বাধ্যতামূলক অবসর কার্যক্রম চলছে। জনদাবির মুখে আইন শৃংখলা বাহিনীর অনেক বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পাকড়াওয়ের চেস্টা চলছে। এর মধ্যেই প্রবাদের ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া’ খাওয়া লোকদের আবির্ভাব ঘটেছে। সুযোগ সন্ধানীরা দখল, চাঁদাবাজি নানা অপকর্ম শুরু হয়েছে। পুলিশের গণহারে মামলা এবং আসামীদের গ্রেফতারের নামে চলছে মহাবাণিজ্য। আবার প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা দাবি আদায়ের নামে নানা প্রক্রিয়ায় আন্দোলন করছেন। এসব নিয়ন্ত্রণ করে দেশ পুনর্গঠনে ড. মুহম্মদ ইউনূসের সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে।
গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকার যখন বিচারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘকে সত্য অনুসন্ধানে আহ্বান জানিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় কিছু অতি উৎসাহী ও স্বার্থান্বেষী মহল আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এবং প্রতিবাদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোরপূর্বক পদত্যাগ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনি তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ, আদালতে আসামিকে আক্রমণ করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী এসব কার্যকলাপের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার সব দুষ্কৃতকারীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযান চালাবে এবং দলমতনির্বিশেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার নিপীড়নের বিচার করতে বদ্ধপরিকর জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন হলে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। গণ-অভ্যুত্থান দমন করতে পতিত সরকার নিষ্ঠুর বল প্রয়োগ করলে বহু প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এতে দীর্ঘদিনের দুঃশাসনে বহু মানুষ অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব নিপীড়নের বিচার করতে বদ্ধপরিকর।
হাসিনা পালিয়ে ভারত গেলেও তার দোসররা এখনো সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছেন। সচিব থেকে শুরু করে ডিসি, ইউএনও এবং পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, এমনকি সংস্থা, কর্পোরেশন, অধিদপ্তর পরিদপ্তরে কর্মকতাদের বেশির ভাগই শেখ হাসিনার নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে অন্তর্বতী সরকারের অধীনে চাকরি করছেন। আর গত ১৫ বছরে প্রশাসনের নিম্নপদে নিয়োগকৃতদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হাসিনা পালালোও তারা এখনো সুকৌশলে দিল্লির আঁকানো ছকে নতুন সরকাকে বিপদে ফেলতে তৎপর। বিশেষ করে গত দুই সাপ্তাহে শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, নেতা, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাবেক আমলা, ১৪ দলীয় শরীক জোটের নেতা, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিষ্টার সারা হোসেন বলেছেন, ‘মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা হচ্ছে এগুলো টিকবে না। ছাত্র আন্দোলনের ফসলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে মামলাগুলো। মামলার কোনোটিতে ৩০, ৪০ ও ৫০ জনের বেশি করে আসামি। এই মামলাগুলো কি পুলিশ সৎভাবে করছে? বুঝে করছে?’
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ কোটায় চাকরি পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজধানী ঢাকাকে বিক্ষোভ-সমাবেশ-মানববন্ধনের শহরে পরিণত করেছে। প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় করছে দাবি আদায়ের আন্দোলন। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন থেকে শুরু করে সচিবালয়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, পল্টন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ সব এলাকায় চলছে দাবি আদায়ের আন্দোলন। এমনকি বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভিতরেও বিক্ষোভ করা হচ্ছে। সচিবালয়ের ভিতরে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এবং তাদের দাবি মেনে নেয়ার ভুল সিদ্ধান্তের পর আনছার বাহিনী নজীরবিহীনভাবে সচিবালয় ঘেড়াও করে।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন আর সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মচারী ইউনিয়নের ব্যানারে আন্দোলনের নামে বিশৃংখলা করতে দেবে না। অপরাধীদের ধরতে গতকালই শুরু হয়েছে যৌথ অভিযান। এ অভিযান অব্যহত থাকবে। এ ছাড়াও সরকারি কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নেটিজেনরা বলছেন, ১৫ বছর দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন না করে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন রহস্যজনক। অনেকেই এসবকে হাসিনার ইন্দনে ‘. ইউনূস প্রশাসনকে অস্থির করার চেষ্টায়’ হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের দাবি দাওয়া হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু তারা বিগত ১৫ বছর তেমন আন্দোলন করেনি। নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশ পুনর্গঠন করছে। সরকারকে সময় দিতে হবে। গত জুলাই মাসে দেশে হাসিনা রেজিমের বিরুদ্ধে ছাত্রগণআন্দোলন ঠেকাতে হাসিনা রেজিমের পুলিশ বাহিনী যেভাবে রাজপথে রক্ত ঝড়িয়েছে। ১৫ বছর লুটপাটের মাধ্যমে যে ভাবে দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশকে ঋণগ্রস্থ জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তুলেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সরকারকে সময় দিতে হবে।
সর্বশেষ আপডেট: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪২
পাঠকের মন্তব্য