চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় দিনভর অচল হয়ে পড়েছিল দেশের স্বাস্থ্যসেবা। শুরুতে ঢামেকে কর্মবিরতি এরপর সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণায় দেশের চিকিৎসাসেবায় অচলাবস্থা তৈরি হয়। দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগসহ সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুমূর্ষু রোগীরা ছুটে আসেন। তৈরি হয় রোগীদের ভিড়। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় ফিরে যেতে হয় অন্যত্র। নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার কথা বলেও চিকিৎসকদের কাজে ফেরাতে পারেনি। এরমধ্যে দুপুরে ঘোষণা আসে সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউনের। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঢামেক হাসপাতালে ছুটে আসেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহরা। আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন চিকিৎসা সেবায়।
তবুও সমাধান হয়নি। এরপর ছুটে আসেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। বিকাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কয়েক দফা বৈঠক হয় আন্দোলনরতদের সঙ্গে। এরপর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এবং ছাত্র সমন্বয়কদের আশ্বাসে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি স্থগিত করেন আন্দোলনরত চিকিৎসকরা। তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীকে। দিনভর নাটকীয়তা শেষে ঢামেক হাসপাতালে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ঘটনার সূত্রপাত : গত শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের অবহেলায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী আহসানুল হক দীপ্তর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের তিন চিকিৎসককে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দোষীদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের আল্টিমেটাম দেন চিকিৎসকরা। একই দিন মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ এলাকা থেকে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহতরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসেন। তখন অন্য আরেক গ্রুপ চাপাতিসহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরে ঢুকে যায়। এ সময় হাতেনাতে চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনীকে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে ওই রাতে অন্য আরেক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারে ভাঙচুর চালায় রোগীর স্বজনরা। এতে নিরাপত্তা শঙ্কায় গতকাল রোববার সকাল থেকে জরুরি বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। আল্টিমেটামের ২৪ ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই কর্মবিরতিতে যান তারা।
এদিকে ঢামেক হাসপাতালের (ঢামেক) নিউরো সার্জারি বিভাগের তিন চিকিৎসকের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা হয়। মামলায় বেসরকারি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষকসহ তিন শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪০-৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। গতকাল ঢামেক হাসপাতালের অফিস সহায়ক আমির হোসেন (৫৩) বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। অন্যদিকে, গতকাল রোববার দুপুরে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, দোষীদের গ্রেফতার ও সেনাবাহিনী মোতায়েন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশের সব হাসপাতালে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করা হয়। হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন আব্দুল আহাদ এ ঘোষণা দেন। তিনি চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয়দের পক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আব্দুল আহাদ বলেন, সারা দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এই কর্মসূচির আওতাভুক্ত হবে।
চিকিৎসকদের আন্দোলনে ভোগান্তিতে রোগীরা
কুমিল্লা থেকে বাবাকে চিকিৎসা দিতে ঢামেকের জরুরি বিভাগে এসেছেন বিল্লাল হোসেন। তিনি জানতেন না চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কথা। জরুরিভিত্তিতে তার বাবার চিকিৎসা প্রয়োজন। সেজন্য ঢাকা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এসে দেখেন ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। অনুরোধ করেও কাজ হয়নি। তিনি জানান, কর্মচারীরা আমাকে বললো জরুরি বিভাগে কোনো ডাক্তার নেই। এখন বাধ্য হয়েই অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। এভাবে চরম ভোগান্তি তুলে ধরেন তিনি। তিনি জানান, সরকারের উচিত এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করা। সারা দেশের মানুষের ভরসা স্থল হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখান থেকে যদি নিরাশ হয়ে ফেরত যেতে হয় তবে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক বড় বিপদ।
মুন্সিগঞ্জ থেকে জুম্মন মিয়া নামে এক রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা রুবেল বলেন, আমার মামার বুকে ব্যথাজনিত কারণে ঢামেকে এসেছি। কিন্তু চিকিৎসকদের কর্মবিরতি কারণে হার্ট ফাউন্ডেশন নিয়ে যাচ্ছি।
সাভারের আশুলিয়া থেকে জয়নাল আবেদীনকে নিয়ে আসা তার ভাই মোহাম্মদ বাবর আলী বলেন, সকালে ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় আমার ভাই তৃতীয় তলা থেকে নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসার পর চিকিৎসকদের কর্মবিরতি দেখে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। শুধু বিল্লাল, জুম্মন কিংবা জয়নাল আবেদীন নয় গতকাল দিনের বেলায় ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগী ও তাদের স্বজনদের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গতকাল সকালে চিকিৎসকরা কাজে যোগ দিলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান তারা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসাররা তাদের কক্ষ বন্ধ করে দেন, বন্ধ করে দেওয়া হয় জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টার। এরপর থেকেই ঢাকা মেডিকেলের সামনে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড় বেধে যায়। পরিস্থিতি ঠেকাতে ঢামেকের জরুরি বিভাগ এবং প্রশাসনিক ব্লকের সামনে অবস্থান নিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আন্দোলনরত চিকিৎসকদের বৈঠকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা-সমন্বয়করা ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেকে) হামলার প্রতিবাদে চিকিৎসকদের কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণার পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে ঢামেক সভাকক্ষে আলোচনায় উপস্থিত হন তিনি। এসময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে উপস্থিত হন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান, ঢামেক চিকিৎসকরাসহ সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের কর্মকর্তারা। এর আগে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মো. সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, আমি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে এখনই আলাপ করবো। আমাকে দুদিন সময় দাও, যেন ব্যবস্থা নিতে পারি। এছাড়া অন্য দাবিগুলো নিয়ে আমরা কী করতে পারি তা আলোচনা করবো। এ সময় আন্দোলনকারীরা বলেন, এর আগেও দাবি পূরণ হবে বলে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হলেও তা হয়নি। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, আমরা কোনো পলিটিক্যাল সরকার না। ওয়েট অ্যান্ড সি। এর আগে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, কথায় কথায় চিকিৎসকদের ওপর চাড়াও হওয়া কাম্য নয়। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকদের ওপর হামলায় দোষীদের বিরুদ্ধে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আইনি ব্যবস্থা নিতে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এটি হিমাগারে যাওয়ার মতো তদন্ত কমিটি নয়। আগামী তিন কর্মদিবসে রিপোর্ট দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলের পর আরও দুটি জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো খুবই দুঃখজনক। ডাক্তাররা তাদের যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করেছেন। এভাবে কথায় কথায় ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলা যাবে না। আন্দোলনরত ডাক্তাররা আমাদের সন্তানের মতো। তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাবো শাটডাউন তুলে নাও। মানুষের সেবায় এসেছো, মানুষের সেবায় ফিরে যাও। ঢামেকে চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় বিজিবি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। সার্বিক বিষয় নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে কথা বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ক্যাজুয়ালিটি এবং নিউরো সার্জারিতে চিকিৎসাসহ অন্যান্য চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। একইসঙ্গে কর্মরত চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স, এক প্লাটুন পুলিশ, দুই প্লাটুন বিজিবি ও আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। সেনাবাহিনী হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। আমি ব্যর্থ হতে চাই না। আমরা চেষ্টা করছি সর্বোচ্চটা দিয়ে। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা জরুরি চিকিৎসাসেবা চালু করবেন। তাদের নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। চিকিৎসক মারধরের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আটক বা গ্রেপ্তার করার পরপরই তারা সম্পূর্ণভাবে চিকিৎসাসেবা দেবেন। কিন্তু এখন থেকেই জরুরি চিকিৎসাসেবা শুরু হচ্ছে। কমপ্লিট শাটডাউন আর নেই। এটা থেকে চিকিৎসকরা সরে এসেছেন। তারা এখনই জরুরি সেবা চালু করছেন। যে নিশ্চয়তা তারা চেয়েছিল সেই নিশ্চয়তা স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তাদের দিয়েছেন।
ডাক্তার ভাইদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে : সারজিস আলম
ঢামেকে ডাক্তারদের উপর হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম। হামলাকারীদের বিচারের দাবিও তুলেছেন তিনি। গতকাল নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, আমার ডাক্তার ভাইদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তাদের উপরে যে বা যারা হাত তুলেছে তাদের উপযুক্ত বিচার করতে হবে। কোনো রোগীর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী হলে তা তদন্ত সাপেক্ষে বিচার করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, যদি কোনো পেশেন্টের মৃত্যুর জন্য হসপিটাল কর্তৃপক্ষ বা কোনো ডাক্তার দায়ী থাকে তবে তদন্ত সাপেক্ষে তারও বিচার হতে হবে। কিন্তু আমার মনে হলো আর আমি কারো গায়ে হাত তুলে ফেললাম, এই স্পর্ধা কখনো মেনে নেয়া যায় না। সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতা সোচ্চার আছে। সূত্র :ইনকিলাব
সর্বশেষ আপডেট: ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:১০
পাঠকের মন্তব্য