গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টাদের করতালির মধ্যে এই সনদে স্বাক্ষর করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার জন্য প্রণীত ‘জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন-২০০৯’বাতিল করা হয়েছে।জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তার সুবিধা ভোগ করতে পাবেন না।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশের খসড়াটি বাতিলের অনুমোদন দেওয়া হয়। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সভা শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, কালো টাকা সাদা করার বিধি এবং রীতি সেটা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কারণ এখান থেকে সরকার যেটুকু টাকা আনতে পারে তা দিয়ে সরকারের যে খুব বেশি কিছু আগায় তা না। বরং মূল্যবোধটা অনেক বেশি অবক্ষয়িত হয়। ফলে এটার বিরুদ্ধে স্পষ্ট একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে বলে জানান অন্তর্বতী সরকারের এই উপদেষ্টা। নিত্যপণ্যের দাম কমানো প্রসঙ্গে রিজওয়ানা হাসান বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে যা যা করা দরকার সেই কাজগুলো শুরু করে দিয়েছে।
পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। এতে বলা হয়, বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯ জারি করা হয়েছিল। পরে ২০১৫ সালে এই আইন অনুসারে বিশেষ নিরাপত্তা এবং সুবিধাদি প্রদানের গেজেট জারি করা হয়। কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনটি করা হয়েছিল, যা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার সব বৈষম্য দূর করতে দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেছে। বর্তমানে সংসদ না থাকায় এ আইন রহিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করা প্রয়োজন। এ প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টা পরিষদ জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশের খসড়া লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের আইনি যাচাই (ভেটিং) সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়াও অনুমোদন দেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যগণ’ এবং কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছিল।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ আইনের আওতায় প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনের আওতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যগণের নিরাপত্তা প্রদান সংক্রান্ত বিধানগুলো প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। তাই এ আইনের কিছু বিধান বিলোপসহ অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি সংযোজন করে অধ্যাদেশের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বলা হয়, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ\ আগামীকাল ৩০ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসের আগেই এই সনদে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে সরকার ইতোমধ্যে হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ইতোমধ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করে গত মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তদন্ত কমিশন আইন, ১৯৫৬ সালের ক্ষমতাবলে এই কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের’ জন্য এ কমিশন।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের অভিযোগ নিয়ে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সমালোচনা রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত গোপন বন্দিশালা থেকে দীর্ঘ সময় পর বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মুক্ত হওয়ার পর গুমের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সাত শ’র বেশি মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৫০ জনের বেশি মানুষের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ৯টি সনদের ৮টিতে সই করেছে। জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের অনুরোধের পরও বিগত সরকার গুমবিরোধী সনদে সই করেনি। অন্তর্র্বতী সরকার মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি গুমের সংস্কৃতি বন্ধ করতে চায়। এ লক্ষ্যে সরকার গুমবিরোধী সনদে যুক্ত হতে যাচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিটি গুমের তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে দেশবাসীর কাছে প্রতিশ্রুটি ব্যক্ত করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাসমূহের বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করা এবং এতদ্বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা; জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাহাদের আত্মীয়-স্বজনকে অবহিত করা এবং জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে এই কমিশন। বিরোধী সনদটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ এটি অনুস্বাক্ষর করার পরে ২০১০ সালে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে এই সনদের লক্ষ্য গুম বন্ধের পাশাপাশি এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া।
সর্বশেষ আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০১:১৮
পাঠকের মন্তব্য