স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের দোসর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শীর্ষ কর্মকর্তাদের অপসারণ দাবি করেছেন সংস্থাটির নিজস্ব কর্মকর্তারা। সেইসঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দীর্ঘ বঞ্চনা- বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং প্রতিষ্ঠান থেকে আমলাতন্ত্রের মূলোৎপাটনের মাধ্যমে স্বশাসিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সগৌরবে মাথা উঁচু করে কার্যক্রম পরিচালনা করার দাবি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের ধামাধরা এ কমিশনকে সত্যিকারার্থে একটি পেশাদার দুর্নীতি দমন কমিশন হিসেবে ঢেলে সাজানো, কমিশনের কতিপয় সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের সরিয়ে তাদের স্থলে দীর্ঘদিন ধরে কমিশনে কোণঠাঁসা, বঞ্চিত ও নানাভাবে নিগৃত দক্ষ কর্মকর্তাদের যথাযথ মূল্যায়ণ করে পতিত সরকারের সকল দুর্নীতি উদঘাটনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন আইনজ্ঞ এবং বিশ্লেষকরা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা একান্ত আলাপচারিতায় এ প্রতিবেদকের কাছে উপরোক্ত দাবি তুলে ধরেন।
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার দেড় দশকের দু:শাসনের প্রধান দোসর ছিলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যখন যাকে খুশি মামলা দিয়ে বিপর্যস্ত করে তোলায় প্রতিষ্ঠানটির জুড়ি ছিলো না। যা সংস্থাটির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বহু দূরে। দুর্নীতি মুক্ত দেশ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে তৎকালিন বিএনপি সরকার ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ গঠন করে। কিন্তু ২০০৬ সালের পর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান লক্ষ্যবস্তুই হয়ে ওঠে বিএনপি’র রাজনীতিক, এ ঘরানার ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। পরবর্তী দেড় দশক ধরে আওয়ামী সরকার দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটিকে কব্জায় নিয়ে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে। একইসঙ্গে সরকারের অবাদ লুন্ঠন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লোপাট, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার এবং বিভিন্ন সেক্টরে কথিত ‘ব্যবসায়ী’ নামক অলিগার্কদের সুরক্ষা প্রদানই হয়ে ওঠে দুদকের মূল কাজ। অনেক সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল কিংবা কোম্পানির শেয়ার হাতিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অলিগার্কদের পক্ষে ভাড়া খেটেছে দুদক। বৃহৎ দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে চুনোপুটি ধরে বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছে। সরকারদলীয় দুর্নীতিবাজদের ধরার নামে কখনো কখনো করেছে আইওয়াশ। দুদকের এসব কর্মকান্ড সংস্থাটিকে মানুষের কাছে হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতিবাজ আওয়ামীলীগ সরকার দুদককে পুষেছে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে। একই সঙ্গে নিজদলীয় দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দিতে। এ কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপেও নেয়া হয় মহা দুর্নীতির আশ্রয়। দুদক আইনে নামকাওয়াস্তে একটি বাছাই কমিটি থাকলেও কমিশনের চেয়ারম্যান-কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে। গণভবন থেকে শেখ হাসিনা নাম ঠিক করে দিতেন। কথিত বাছাই কমিটি সেই নাম প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব করতো। প্রেসিডেন্ট তাদের দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ দেন। এ প্রক্রিয়ায় দুদক পরিচালনা করেন শেখ পবিবারের প্রতি নতজানু অবসরপ্রাপ্ত আমলা মো: গোলাম রহমান, মো: বদিউজ্জামান, ইকবাল মাহমুদ এবং বর্তমানে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তিন সদস্যের কমিশনে বর্তমানে চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন শেখ হাসিনার অনুগত আমলা মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। কমিশনার হিসেবে রয়েছেন নানাভাবে বিতর্কিত ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো: জহুরুল হক এবং শেখ হাসিনার পারিবারিক ঘনিষ্টজন মোছা: আসিয়া খাতুন। এর মধ্যে জহুরুল হক বিডিআর পিলখানা হত্যা মামলার বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন। যদিও পরিবর্তীতে বৃহৎ এ হত্যাকান্ডের বিচার তিনি করেন নি। বিচারক হিসেবে তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ। বিচারক হিসেবে অবসর নিয়ে নিয়োগ নেন বিটিআরসি’তে। সেখানেও তিনি বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছোট ভাইয়ের নামে গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল ব্যবসা। দুদকের কমিশনার নিযুক্ত হয়ে তিনি বেনামে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হন। পূর্বাচলে ১০ কাঠা প্লটের ওপর বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে তার।
কমিশনে সর্বশেষ নিয়োগ লাভ করেন মোছা: আসিয়া খাতুন। তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোকাম্মেল হোসেনের স্ত্রী। দুর্নীতিবাজ মোকাম্মেল শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। এ কারণে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গেলেও পরবর্তীতে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ সচিব করা হয়। মোকাম্মেলের বিরুদ্ধে দুদকে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। মোছা: আসিয়া খাতুন সেটি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন-মর্মে জানা যায়।
দুদকের লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী দু:শাসনের পুরোটা সময় জুড়ে দুদককে রাখা হয়েছে আমলাদের কব্জায়। এতে প্রতিষ্ঠানটিতে ভর করে স্বেচ্ছাচারিতা। চিহ্নিত বড় বড় দুর্নীতিবাজদের তোঁয়াজ করেছে। ঋণের নামে ব্যাংক লুট এবং হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করলেও তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করেনি। উপরন্তু দুদকের অভ্যন্তরে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ে দুর্নীতি। নোটিশ বাণিজ্য, জিজ্ঞাসাবাদ বাণিজ্য, অনুসন্ধানের নামে নিরীহ ব্যক্তিদের হয়রানি, গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, টাস্কফোর্সের কথিত অভিযানের নামে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, গণশুনানির নাটক মঞ্চায়ন, সততা স্টোর উদ্বোধন, দুর্নীতি প্রতিরোধের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয়, দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনার নামে বিশেষ আদালতে মোশাররফ হোসেন কাজল এবং উচ্চ আদালতে অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান নামক দুই আইনজীবীর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা, মামলা পরিচালনার ফি’র হিসেবে দুই আইনজীবীকে গত ১৬ বছরে ফি বাবদ কোটি কোটি টাকা প্রদান, দুর্নীতিবাজ আমলাদের সুরক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কীপয়েন্টে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রহরায় বসানো, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের ‘বিএনপি-জামায়াত’ তকমা দিয়ে কোনঠাঁসা করে রাখা, তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি প্রদান না করা, শরীফউদ্দীনের মতো সাহসী কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নানাভাবে পুরষ্কৃত করা, তাদের কাছ থেকে ফরমায়েশী তদন্ত প্রতিবেদন করানো, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের অনুসন্ধানের নামে আইওয়াশ করে দায়মুক্তি প্রদানের মতো নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে দুদক। এ হেন প্রতিষ্ঠানটিকে সত্যিকার্থে দুর্নীতিবিরোধী কমিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠায় ঢেলে সাজানো জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বিশ্লেষকরা। আর এ লক্ষ্যে দুদকের বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দুর্নীতি কমিশনারকে দ্রুত অপসারণ করতে হবে। তারা প্রত্যেকেই শেখ হাসিনা মনোনীত, নিয়োজিত এবং পালিয়ে যাওয়া সরকারের সুফলভোগী, দুর্নীতির সহযোগী। তাদের সপদে বহাল রেখে কখনোই অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে না। বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠনও সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ও ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র মনজিল মোরসেদ বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। বর্তমান কমিশনকে দিয়ে দুর্নীতি মুক্ত জাতি গঠন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো: মঈদুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনগত কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। সীমাবদ্ধতা শুধু সদিচ্ছার। বিদ্যমান আইন এবং জনবল দিয়েই কমিশনকে কার্যকর, শক্তিশালী, গতিশীল, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।
সর্বশেষ আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২৪, ০২:০১
পাঠকের মন্তব্য