বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নিয়েছে নতুন সরকার। দ্বিতীয় স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকার এটি। এ এক নতুন সূর্যোদয়। লাল-সবুজের বাংলাদেশের নতুন পথ চলা। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের কবর রচনা। অতঃপর যাত্রা শুরু নতুন স্বপ্ন সারথীর।
গতকাল রাত সোয়া ৯টায় দেশী-বিদেশী ৪ শ’ অতিথির উপস্থিতে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরপর শপথ গ্রহণ করেন দু’জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধিসহ ১৩ জন। তাদেরও শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। ঢাকার বাইরে অবস্থান করায় ফারুক ই আযম, বিধান রঞ্জন রায় ও সুপ্রদীপ চাকমা উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিতে পারেন নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া অন্য উপদেষ্টারা হলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’র প্রধান অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ, অবসরপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, পরিবেশ আইনবিদ সমিতি ‘বেলা’র প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো: নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, নারী নেত্রী ফরিদা আখতার, বাংলাদেশী সুন্নি দেওয়াবন্দী ইসলামিক ব্যক্তিত্ব ড. আ.ফ.ম খালিদ হাসান, গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালক নুরজাহান বেগম এবং ‘ব্্রতী’র প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ।
শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি’র প্রেসিডিয়াম মেম্বার ড.মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, এলডিপি’র চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুল ইসলাম, জাতীয় পার্টি (জেপি)র চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্য’র আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি’র সভাপতি আ.স.ম. আব্দুর রব, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক, এনপিপি’র চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বিকল্প ধারার চেয়ারম্যান ড. নূরুল আমীন বেপারি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র মহাসচিব ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র মহাসচিব প্রিন্সিপাল ইউনূস আহমাদ, গণদলের চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মওলা চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বামপন্থি রাজনীতিকদের মধ্যে মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রুহিন হোসেন প্রিন্স ও জোনায়েদ সাকি সহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা, সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের সচিব, পদস্থ কর্মকর্তা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ এবং দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কোনো নেতাকে শপথ অনুষ্ঠানে দেখা যায় নি। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালিন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ইরান, আর্জেন্টিনা, ফিলিস্তিন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ উপস্থিত ছিলেন।
শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব ড. মাহবুবুর রহমান। যথারীতি জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শপথের মূল আনুষ্ঠানিকতা। প্রথমেই দু’বার শপথ গ্রহণ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথমত: প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ, দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার শপথ।
নতুন বিজয় সৃষ্টি হলো : ড. মুহাম্মদ ইউনূস
এর আগে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে অভ্যর্থনা জানান, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ তিন বাহিনীর প্রধান। পরে তিনি বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সংবাদকর্মীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করাই হবে আমার প্রথম কাজ। কারও ওপর কোনো হামলা যাতে না হয় সেই আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন। আপনারা যদি আমার ওপর ভরসা রাখেন, তাহলে কারও ওপর হামলা হবে না।’ আগামীর সরকারের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, সরকারকে দেখে মানুষ ভয় পাবে না। তাদের বুক ফুলে উঠবে যে সরকার আমাদের সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, ‘বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশে আজকে নতুন বিজয় সৃষ্টি হলো। তরুণ সমাজ এটা সম্ভব করেছে। তাদের প্রতি আমরা সমস্ত কৃতজ্ঞতা জানাই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ছাত্ররা আমার ওপর আস্থা রেখে আহ্বান করেছে, আমি তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছি। দেশবাসীর কাছে আমার আবেদন-আপনারা যদি আমার ওপরে বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত করেন দেশের কোনো জায়গায় কারো ওপরে হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব। এটা যদি আমি করতে না পারি, আমার কথা যদি আপনারা না শোনেন তাহলে আমার প্রয়োজনীয়তা এখানে নেই। তাহলে আমাকে বিদায় দেন, আমার কাজে আমি ব্যস্ত থাকি।
সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাকে প্রয়োজন মনে করলে আপনাদের দেখাতে হবে যে আমার কথা আপনারা শোনেন। আমার প্রথম কথা হলো-আপনারা বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেন, আপনারা সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন যেন আমাদের ছাত্ররা আমাদের পথ দেখায়, সেই পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
বাংলাদেশ একটি খুব সুন্দর সম্ভাবনাময় দেশ। এখন আবার সেই বিস্তর আমাদের তৈরি করতে হবে, আবার আমাদেরকে জেগে উঠতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, তারাই (ছাত্ররা) এই বিস্তর তৈরি করবে। তাদের দিকে আমরা তাকাবো এবং তাদের নির্দেশিত পথে আমরা অগ্রসর হবো। এখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন- সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর প্রধানরা যারা আছেন তাদের প্রতি অনুরোধ- আমরা একটা পরিবার, এটার মধ্যে যেন আমাদের গোলযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে একসঙ্গে চলতে পারি। আমরা তড়িৎগতিতে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার দিকে এগিয়ে যতে পারি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদের কথা স্মরণ করে এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজকে আমার আবু সাঈদের (রংপুরে গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী) কথা মনে পড়ছে। যে আবু সাঈদের কথা দেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে।
ক্ষণজন্মা একজন ইউনূস
ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৮ জুন। বৃটিশ ভারতের তৎকালিন ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’র হাটহাজারির কাপ্তাই সড়কের বাথুয়া গ্রামে। পিতা-হাজী দুলা মিয়া সওদাগর। মা- সুফিয়া খাতুন। ভাই- বোনদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। শৈশব কাটে গ্রামে। ১৯৪৪ সালে তার পরিবার চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। ভর্তি হন লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হন। পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে মেধা তালিকায় তিনি ছিলেন ১৬তম। স্কুল জীবনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় স্কাউট। ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত এবং ১৯৫৫ সালে কানাডায় জাম্বোরিতে অংশ নেন। ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। এ সময় তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ছিলেন সক্রিয়। নাটকে অভিনয়ের জন্য পুরষ্কারও জেতেন। ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। ১৯৫০ সালে বিএ পাস করেন। এমএ সম্পন্ন করেন ১৯৬১ সালে। স্নাতক শেষে তিনি নুরুল ইসলাম এবং রেহমান সোবহানের অর্থনৈতিক গবেষণায় ‘গবেষণা সহকারী ’ হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। একই সময় তিনি চাকরির পাশাপাশি একটি লাভজনক প্যাকেজিং কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়শুনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যাযে গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ইউনুস মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেন্সি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যান্য বাংলাদেশীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করেন। তিনি ন্যাশভিলের তার বাড়ি থেকে ‹বাংলাদেশ নিউজলেটারও› প্রকাশ করতেন। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে নিযুক্ত হন। তবে কাজটি তার কাছে একঘেয়ে লাগায় তিনি ইস্তফা দেন। যোগদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। অর্থর্নীতি বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। এ সময় তিনি অর্থনৈতিক কাজের ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেন। তিনি গ্রামীণ আমেরিকা এবং গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বোর্ড সদস্য, যা ক্ষুদ্র ঋণকে সমর্থন করে।
দারিদ্র্য দূরীকরণে নিরন্তর লড়াই
ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্রতার বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৪ সালে। আওয়ামী দু:শাসনে দেশে তখন দুর্ভিক্ষ। ড. ইউনূস বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সে সময় তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন। যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে প্রকল্পটি আরো কার্যকর করতে ইউনুস এবং তার সহযোগীরা ‹গ্রাম সরকার› কর্মসূচি প্রস্তাব করেন। যা পরবর্তীতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেন। এ কর্মসূচির আওতায় সরকার ২০০৩ সালে ৪০,৩৯২টি গ্রাম সরকার গঠিত হয়। যা চতুর্থ স্তরের সরকার হিসাবে কাজ করত। ২০০৫ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) দায়ের করা একটি পিটিশনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গ্রাম সরকারকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে উদ্ভাবকদের সহায়তার জন্য ইউনুসের ক্ষুদ্রঋণ ধারণা ‹ইনফো লেডি সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশীপ› প্রোগ্রামের মতো কর্মসূচিকে অনুপ্রাণিত করে।
স্বীকৃতি ও অর্জন : স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৮৭), বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (১৯৯৪), আন্তর্জাতিক গান্ধী শান্তি পুরষ্কার (২০০০), ভলভো পরিবেশ পুরস্কার (২০০৩), নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০০৬), প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯), কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (২০১০),ড. মুহাম্মদ ইউনুস হলেন মাত্র সাতজন ব্যক্তির একজন, যিনি নোবেল শান্তি পুরষ্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল লাভ করেছেঠন। ২০২০ সালে তিনি ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি থেকে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। ২০১১ সালে ইউনুস সাস্কিয়া ব্রুইস্টেন, সোফি আইজেনম্যান এবং হ্যান্স রাইটজের সাথে একত্রে ইউনুস সামাজিক ব্যবসা – গ্লোবাল ইনিশিযেটিভস প্রতিষ্ঠা করেন। ইউনুস সামাজিক ব্যবসা সারা বিশ্বে সামাজিক সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য সামাজিক ব্যবসা তৈরি ও ক্ষমতায়িত করে। ইউনুসের নতুন, মানবিক পুঁজিবাদের দৃষ্টিভঙ্গির আন্তর্জাতিক বাস্তবায়ন শাখা হিসেবে এই সামাজিক ব্যবসা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সামাজিক ব্যবসার জন্য ইনকিউবেটর তহবিল পরিচালনা করে এবং কোম্পানি, সরকার, ফাউন্ডেশন এবং এনজিওদের পরামর্শ সেবা প্রদান করে। ২০১২ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন । এই পদে তিনি ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের কার্যক্রমকে সমর্থনকারী জনহিতকর সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেন।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা : ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি জোবরা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় ইউনুস আবিষ্কার করেন যে খুব ছোট ঋণ দরিদ্র মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তৈরি করতে পারে। গ্রামের মহিলারা যারা বাঁশের আসবাব তৈরি করতেন, তাদের বাঁশ কিনতে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হতো । তাদের লাভ ঋণদাতাদেরকে দিতে হতো। প্রথাগত ব্যাংকগুলো দরিদ্রদেরকে উচ্চ ঋণখেলাপির ঝুঁকির কারণে যুক্তিসঙ্গত সুদে ছোট ঋণ দিতে চায়নি। কন্তু ইউনুস বিশ্বাস করতেন যে, সুযোগ পেলে দরিদ্ররা উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হবে না, তাদের নিজেদের পরিশ্রমের লাভ রাখতে পারবে, সেজন্য ক্ষুদ্রঋণ একটি কার্যকর ব্যবসায়িক মডেল হতে পারে। ইউনুস তার নিজের টাকা থেকে ২৭ মার্কিন ডলার ঋণ দেন গ্রামের ৪২ জন মহিলাকে। যারা প্রতি ঋণে ০.৫০ টাকা (০.০২ মার্কিন ডলার) লাভ করেন। এ কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে ক্ষুদ্র ঋণের ধারণার জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয়।
নোবেল জয় : ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী যিনি বিরল এই সম্মানে ভূষিত হন।
শেখ হাসিনার রোষানল : বিশ্ববরেণ্য অর্থর্নীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরষ্কার জিতে বাংলাদেশকে সারাবিশ্বে তুঙ্গীয় মর্যাদার আসনে উড্ডীন করলেও পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন ঈর্ষান্বিত। শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নিজের ইমেজকে ছাপিয়ে অন্যকেউ দেশ-বিদেশে এতোটা গ্রহণযোগ্যতা পাবেন-এটি তিনি মানতে পারেন নি। তাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি বিষোদগার ছিলো শেখ হাসিনার নিত্য চর্চা। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে কখনো ‘সুদ খোর’, ‘রক্ত চোষা’, ‘ষড়যন্ত্রকারী’, ‘শ্রমিকের টাকা আত্মসাৎকারী’ ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরোধিতাকারী’ কখনো ‘ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী’সহ নানা অশ্রাব্য, অসম্মানজনক অভিধায় ভূষিত করেন। পদ্মাসেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মা সেতু থেকে চুবিয়ে দেয়ার কথাও বলেন। যদিও এসবের কোনো জবাব প্রদান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রুচিতে আসেনি। রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি আক্রান্ত হন শ্রম আইন লঙ্ঘনের কথিত অভিযোগে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় কারাদ- প্রাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ করে। তার বিরুদ্ধে চার্জশিটও দাখিল করে। এসব মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়মিত কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছে। এজলাসে রক্ষিত লোহার খাঁচায় প্রবেশ করতে হয়েছে। চরম অপমান ও ধারাবাগিক নিগ্রহের এক পর্যায়ে দেশের শাসন ব্যবস্থা, সরকার, বিচার বিভাগ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। দেশের বিচার যন্ত্রকে ব্যবহার করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিরবচ্ছিন্ন হয়রানির মধ্যেই জুলাই মাসে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ আন্দোলন শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। ছাত্র-জনতার অভুত গণঅভ্যুত্থানে বিতাড়িত হয় শেখ হাসিনার স্বৈর শাসন। অবসান ঘটে দীর্ঘ মাফিয়া শাসনের। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনরত ছাত্রদের আকাঙ্খার প্রেক্ষিতে তত্ব¦াধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেশের দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সর্বশেষ আপডেট: ৯ আগস্ট ২০২৪, ০৩:১৭
পাঠকের মন্তব্য