জাহাঙ্গীর আলম নামটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। চাকরি করেছেন পিয়নের। অথচ ৪০০ কোটি টাকার মালিক। চলাচল করেন হেলিক্টারে। গত ১৪ জুলাই বিকেল পর্যন্ত এই জাহাঙ্গীর আলমকে কেউ চিনতেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে নামটি উল্লেখ করায় দেশ-বিদেশে জাহাঙ্গীর আলম এখন সবার মুখে মুখে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তিনি এখন হিরো! গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) মো. জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার নির্দেশ দিয়েছে। জাহাঙ্গীর, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে বিএফআইইউ। আর তাদের সব ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে বিএফআইইউ।
জাহাঙ্গীর আলম হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসায় কাজ করা পিয়ন। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ে যাতায়াতের সুবাদে অত্যন্ত প্রতাপশালী জাহাঙ্গীর বহু অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের মতোই নানা জায়গায় হস্তক্ষেপ করে চাঁদাবাজি ও তদবিরের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। জাহাঙ্গীর চক্রে জড়িত হন আরো কয়েকজন। দুর্নীতিবিরোধী চলমান অভিযানের মধ্যে নিজের পিয়নের ৪০০ কোটি টাকা কামাই করায় তাকে বের করে দেয়া হয়েছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্যের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, অবৈধভাবে ৪০০ কোটি টাকা বানানো কে সেই পিয়ন? এখন তিনি কোথায় আছেন? কী করছেন? কীভাবে এতো অঢেল সম্পদের মালিক হলেন এক পিয়ন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত আর কারা কারা এমন অঢেল সম্পদের মালিক? নেটিজেনরা আরো বিতর্ক করছেন একজন পিয়ন যদি ৪০০ কোটি টাকার মালিক হন তাহলে অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কত সম্পদের মালিক?
গত রোববার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান চলতে থাকবে। আমরা এখন দুর্নীতিবাজদের ধরতে পারছি বলেই সবাই জানতে পারছে। আমার বাসায় কাজ করে গেছে, সেই পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক। সে হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। আর, এটাই বাস্তব কথা।’ নিজের সেই পিয়নকে চাকরিচ্যুত করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যখন জানলাম সঙ্গে সঙ্গে তাকে (জাহাঙ্গীর আলম) বাসা থেকে বের করে দিয়েছি। তার কার্ড-টার্ড (পরিচয়পত্র) সব বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছি। ধরা পড়ার পরই এখন সবাই জানতে পেরেছে।’
গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাহাঙ্গীর শুধু অবৈধ সম্পদই অর্জন করেননি, বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের পদ-পদবিও। আওয়ামী লীগের চাটখিল উপজেলা শাখা কমিটির সহ-সভাপতিও ছিলেন। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-১ (চাটখিল ও সোনাইমুড়ী) আসনে নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তবে না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তবে শেষমেশ আর ভোট করতে পারেননি। জানা যায়, আওয়ামী লীগের একটি সুবিধাভোগী অংশ বেপরোয়া জাহাঙ্গীরের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ তোলেন। এরপরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়া পিয়ন জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার খবর প্রথম সামনে আসে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে নানা ‘অনৈতিক’ কাজে জড়িত জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তখন বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করে বেড়াচ্ছেন। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আর এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে প্রয়োজনে নিকটস্থ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ জানানো হয়।
জানা যায়, জাহাঙ্গীর আলম প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বাসার ‘কাজের লোক’ হিসেবে পরিচিত হন। আর এলাকায় তিনি পরিচিত ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়ায় বাড়ি জাহাঙ্গীরের। তার বাবা মৃত রহমত উল্ল্যাহ। জাহাঙ্গীরের ভাই মীর হোসেন জানান, সংসার জীবনে জাহাঙ্গীর দুই বিয়ে করেছে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক সন্তান আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তিন সন্তান রয়েছে। প্রথম স্ত্রী দেশে আছে, তবে তার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রোববার রাতে জাহাঙ্গীর স্ত্রীর কাছে আমেরিকা চলে গেছে। শেখ হাসিনা বিরোধীদলে থাকার সময় তার বাসভবন ‘সুধা সদনের’ ব্যক্তিগত স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। সে সময় বিভিন্ন প্রোগ্রামে শেখ হাসিনার জন্য যে খাবার পানি বাসা থেকে নেয়া হতো, সেটাই বহন করে নিয়ে যেতেন এই জাহাঙ্গীর। এজন্য তিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ হিসেবে পরিচিতি হয়ে ওঠেন। পরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ পান জাহাঙ্গীর। জানা যায়, জাহাঙ্গীর আলম প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন হিসেবে টানা দুই মেয়াদের পাশাপাশি গত মেয়াদেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করলেও তিনি নিজেকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। বাকপটু জাহাঙ্গীর ‘কাজের লোক’ সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতেন ধমকের সুরে। তাকে প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে দেখা যাওয়ায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রি-এমপি ছাড়াও অনেক প্রভাবশালীরাও জাহাঙ্গীরকে সমঝে চলতেন। আর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হন জাহাঙ্গীর। মূলত তিনি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাদের মতোই তদবিরবাণিজ্য করতেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে নানা তদবির করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। অবৈধভাবে বিপুল অর্থ-সম্পদ গড়ার পর রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েন পিয়ন জাহাঙ্গীর। বাগিয়ে নেন চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ।
প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক খবর প্রচার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর নামটি প্রকাশ্যে চলে আসে। তিনি নানা অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্ত-বৈভব গড় তুলেছেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামাতে জাহাঙ্গীর আলম সম্পদের যে তথ্য বিবরণী দিয়েছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। নোয়াখালী ও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় তার রয়েছে অঢেল সম্পদ। একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি, জমি, দোকান, কোম্পানির মালিকানাসহ বিপুল সম্পদের মালিক তিনি। ঢাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক। ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরিনারায়ণপুরে স্ত্রীর নামে রয়েছে ৮ তলা একটি বাড়ি। রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে ২টি দোকান এবং মিরপুরে একটি সাত তলা ভবন ও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহাঙ্গীর কৃষিখাত থেকে প্রতি বছর ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা এবং চাকরি থেকে ৬ লাখ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান। হলফনামার হিসাব অনুযায়ী বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয় তার। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা ছিল। ডিপিএস ছিল পৌনে ৩ লাখ টাকা, এফডিআর সোয়া এক কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে কিনেছেন গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। এছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে তার ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও রয়েছে।
গত সংসদ নির্বাচনের সময় এমপি হওয়ার চেষ্টায় তিনি নোয়াখালীতে বিপুল অর্থও খরচ করেছেন। নগদ টাকা বিলাতেন এবং প্রতিটি সভা-সমাবেশের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন। ঘুরতেন দামি গাড়িতে। মাঝেমধ্যেই তিনি নিজ এলাকায় যাতায়াত করতেন হেলিকপ্টারে। বিভিন্ন সময় সরকারের প্রভাবশালী অনেক মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে যেতেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের পরই লাপাত্তা হয়ে যান জাহাঙ্গীর আলম। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক জাহাঙ্গীরের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইলে গণমাধ্যম কর্মীরা যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর পরিস্থিতি বুঝতে পেরে গ্রেফতার এড়াতে তিনি ওই রাতেই আমেরিকা চলে গেছেন।
সর্বশেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৪, ০২:১৭
পাঠকের মন্তব্য