২০২২ সালের ভয়াবহতার পর বড় বড় কথা আর মিথ্যে আশ্বাস দেয়া ছাড়া সিলেটের বন্যা মোকাবেলায় কার্যকর কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। অথচ সেবার প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি দেখে গিয়েছিলেন। বন্যা মোকাবেলায় ‘সবকিছু করার’ আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেট-১ আসনের এমপি ড. একেএম আব্দুল মোমেন পরের বর্ষার আগেই সুরমা নদী খননের আশ্বাস দিয়েছিলেন। দুই বছরেও সে কাজ শেষ হয়নি। আর ‘উন্নয়নের বরপুত্র’ পরিচিতি পাওয়া আমাদের সাবেক মেয়র, নগরজুড়ে ভাঙাচোরা আর খোঁড়াখুঁড়ি করে যিনি ব্যাপক প্রশংসিত, জলাবদ্ধতা নিরসনের হাজার কোটি টাকা জলেই ফেললেন মনে হচ্ছে তিনি। এখন বৃষ্টি হলেই নগর ডুবছে। ওসমানী হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ফায়ার সার্ভিস অফিসের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো সুরক্ষিত করার ব্যাপারেও এই দুই বছরে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বছর বছর ডুবছে সিলেট। পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্যতা, সরকারে প্রভাব বিস্তারকারী নেতৃত্বের অভাব, সহমতভাই স্বর্বস্ব রাজনৈতিক কর্মী আর স্তাবক নাগরিক সমাজের কারণে আগামীতে এমন দুর্ভোগ আরও পোহাতে হবে বলে মনে করছেন সিলেটবাসীকে। কারন দফায় দফায় ভারতের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতায় কার্যত অচল এখন সিলেট। জেলা ও মহানগরীতে পানিবন্ধী প্রায় ৪ লাখ মানুষ। এর মধ্যে মহানগরে ১৫টি এলাকার ১০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত। আজ মঙ্গলবার (১৮ জুন) বিকালে এসব তথ্য জানিয়েছে সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র।
দেশের মর্যাদাপূর্ণ আসন সিলেট -১ আসন (মহানগর)। এই আসনে প্রবাসীদের বসবাস। তাদের অর্থ বিনিয়োগে আভিজাত্যে শৈল্পিকতার পেয়েছে সিলেট নগরীর । বন্যার কবলে পড়ে জর্জরিত হয়ে তারা এই নগরী বিমূখ হয়ে পড়েছেন। কারন বসবাস যোগ্যতা হারাচ্ছে নগরীর পরিবেশ প্রতিবেশে। যদিও ক্লিন-গ্রিন-স্মার্ট সিটির স্লােগান দিচ্ছেন অভিভাবকরা। তাদের এই স্লােগান যে কেবল কথিত মুখের জবাবদিহীন বুলি, সেকথা হাড়ে হাড়ে ঢের পাচ্ছেন ভূক্তভোগী নগরবাসি। অপরদিকে জেলার সবকটি উপজেলার রাস্তাঘাট বাড়িঘর,স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। বর্ষণ ও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার ছুঁই ছুই অবস্থা। প্রথম দফার বন্যায় জেলার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও দ্বিতীয় দফার এ বন্যায় পূরো সিলেট তলিয়ে গেছে।
জেলার কানাইঘাট, জকিগন্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট সদর, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ উপজেলার সর্বত্র ভয়াবহ বন্যা। বাড়েঘরের পাশাপাশি আঞ্চলিক সড়কগুলো তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সিলেট সদরের হাটখোলা, জালালাবাদ মোগলগাঁও ইউনিয়নসহ কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল প্রভৃতি ইউনিয়নের সকল সড়ক তালিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। এমনকি বাদঘাট কেন্দ্রীয় কারাগার তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা,দেখা দিয়েছে। নগরের শাহজালাল উপশহর, শিবগঞ্জ, সুবহানীঘাট, কুচাই, মেজরটিলা, পশ্চিমভাগ, শ্রীরামপুর, মাছিমপুর,তালতলা প্রভৃতি এলাকা ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে।
নগরীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সিসিকের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনংসযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর। তিনি জানান মহানগরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
সোমবার থেকে সিলেট সিটি করপোরেশনের কয়েকটি ওয়ার্ডে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও বন্যা কবলিত বিভিন্ন পরিদর্শন করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
আজ দুপুর ১টায় সিটি করপোরেশনের ২৬, ২৮ ও ২৯ নং ওয়ার্ডের আশ্রয়কেন্দ্রেগুলোতে যান সিসিক মেয়র। এসময় তিনি কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষের খোঁজ খবর নেন ও বন্যা দুর্গতদের জন্য সিসিকের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলররা ।
এসময় মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বৃষ্টির মধ্যেও গতকাল আমরা সুন্দরভাবে ঈদ পালন করতে পেরেছি।কিন্তু আজ সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।ফলে আমাদের ২৬, ২৮ ও ২৯নং ওয়ার্ড এলাকায় পানি উঠেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছি। বন্যা পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তার জন্য জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও ১৭ পদাতিক ডিভিশনের মেজরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি আমি। এদিকে আজ সন্ধ্যায় সাতটায় নগরভবনে এক জরুর বৈঠকে করেছেন মেয়র।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট জানিয়েছে সোমবার সকাল ৯টা থেকে আজ সকাল পর্যন্ত সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর সিলেট পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর অমলসীদ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ও একই নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সারি নদীর সারিঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩৫সেন্টিমিটার ও সারি-গোয়াইন যৌথ নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসেন জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘন্টায় (সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টায়) সিলেটে ১৫৩ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে ও সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৪৪ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর ভারতের আইএমডি’র তথ্যমতে গত ২৪ ঘন্টায় ৩৯৫ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে চেরাপুঞ্জিতে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবে) সিলেট-এর নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢল নেমে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় ভারত থেকে উজানের পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সবকটি নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার উপরে, সিলেটের সারি নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর অমলসীদ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ও একই নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৭৯ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকার কারণে সীমান্তবতী গোয়াইনঘাট এবং কানাইঘাট উপজেলার কয়েকটি এলাকায় নদীর পানি প্রবেশ করে সৃষ্টি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতি ।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদীর পানি বাড়ার কারণে ১৩টি উপজেলায় মোট ৫৩৮ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ১৩টি উপজেলায় একলাখেরও বেশি মানুষ বন্যার পানিতে আক্রান্ত হলেও বর্তমানে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ৩০০ জনের মত।তবে এই সংখ্যা আজকে আরো বাড়তে পারে।
সার্বিক বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, বন্যাসহ যেকোন দূর্যোগ পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশনায় সিলেট জেলা ও উপজেলার কর্মকর্তাগণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত না হয়ে সকল প্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে কাজ করার অনুরোধ করা হলো।
সর্বশেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২৪, ০২:১২
পাঠকের মন্তব্য