কুলাউড়া উপজেলাধীন ঝিমাই চা বাগানের পরিপক্ক গাছ কাটতে আবারও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বাগানের লিজভুক্ত ভূমিতে বসবাসরত ঝিমাই পুঞ্জির (খাসিয়া) লোকজন। তাদের নানা অপতৎপরতা ও অজুহাতে চা বাগানের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে।
বাগানের অভ্যন্তরে বসবাসরত খাসিয়া পরিবার মেয়াদ উত্তীর্ণ গাছ কাটলে তারা উচ্ছেদ হতে পারেন এ আশংকায় সম্প্রতি নানা তৎপরতায় লিপ্ত থেকে গাছ বিক্রির অনুমোদন যাতে কর্তৃপক্ষ না দেয়, সেজন্য নানা টালবাহানা শুরু করেছে বলে অভিযোগ বাগান কর্তৃপক্ষের। ফলে সরকার কোটি টাকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। চা-বাগান কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কেদারপুর টি কোম্পানি লিমিটেড ১৯৬৮ সালে ৬৬১.৫৫ একর বিশিষ্ট ঝিমাই চা-বাগানটি সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেয়। বন্দোবস্ত নেওয়ার পর ৩১০ একর ভূমিতে চা-গাছ লাগানো হয়েছে। বাকি ভূমির মধ্যে প্রায় ৫ একরে রয়েছে বাগানের অফিস, ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য স্থাপনা রয়েছে।
আগামী ২০৫২ সাল পর্যন্ত বাগানটি সরকারের কাছ থেকে লিজ নেয়া। প্রতিবছর ভূমি উন্নয়ন করসহ সরকারকে সকল রাজস্ব দিয়ে আসছে বাগান কর্তৃপক্ষ। বাগানের লিজ নেওয়া ৩৭১ একর ভূমি দখল করে অর্ধ শতাধিক খাসিয়া পরিবার পান চাষ ও বাড়িঘর তৈরি করে বসবাস করছে। বাগানের লিজকৃত ভূমি থেকে পুরাতন পরিপক্ক গাছগুলো কেটে চা-বাগান বন্দোবস্ত চুক্তি অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ বাগান সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালে ঝিমাই চা বাগানের ২ হাজার ৯৬টি পরিপক্ক গাছ কাটার জন্য অনুমতি প্রদান করে চা-বোর্ড। এর পর থেকে খাসিয়ারা গাছ কাটতে বাঁধা প্রধান করে আসতে থাকে। আইন মোতাবেক চা বাগান কর্তৃপক্ষ গাছ বিক্রির অনুমোদনে এগিয়ে যেতে থাকলে জিমাই খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান রানা সুরং হাইকোর্টে ডিভিশনে ২০০১/২০১৫ রিট পিটিশন দায়ের করার কারণে গাছ বিক্রির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। তবে দীর্ঘ শুনানী শেষে
২০১৭ সালের ৩০ মার্চ হাইকোর্টের রায় চা বাগানের অনুকূলে আসে। পরবর্তীতে মহামান্য হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রানাং সুরং গং সর্বোচ্চ আদালতে আপিল বিভাগে (৪৫৮/১৭) সিভিল আপিল দায়ের করেন। চুড়ান্ত শুনানী শেষে ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আপিলটি খারিজ হয় এবং হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। রায়ে তিনটি শর্ত দেয়া হয় বাগান কর্তৃপক্ষকে। শতগুলো হলো- অপরিপক্ষ গাছ কাটা যাবেনা, প্রতিটি গাছ কাটার পূর্বে ঝিমাই পুঞ্জি এলাকায় উপযুক্তস্থানে দুটি করে চারা রোপণ করতে হবে। নতুন রোপিত চারা কমপক্ষে তিন বছর পরিচর্যা করার পর ঝিমাই পুঞ্জি হতে ঝিমাই চা বাগান কর্তৃপক্ষ স্থানীয় পরিবেশ ও বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিপক্ক গাছ কাটতে পারবে।
রায়ের প্রেক্ষিতে ঝিমাই চা বাগান কর্তৃপক্ষ সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে গাছ কাটার ব্যাপারে সিদ্বান্ত দিতে লিখিতভাবে আবেদন জানালে সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ২০২২ সালে ঝিমাই চা বাগানের ভূমি হতে গাছ কর্তন ও স্থানান্তরের জন্য মার্কিং তালিকা প্রস্তুত পূর্বক দাখিলের নির্দেশনা প্রদান করেন কুলাউড়া রেঞ্জ অফিসারকে। রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ রিয়াজ উদ্দিন সরেজমিনে তদন্ত এবং উচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা মোতাবেক গত ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল তারিখে বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে দেওয়া পত্রে উল্লেখ করেন, চা বোর্ড ঝিমাই চা বাগানের লিজভুক্ত বিভিন্ন দাগে ২ হাজার ৯৬ টি গাছ কাটার অনুমতি প্রদান করেছেন। এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ঝিমাই চা বাগান কর্তৃপক্ষ বাগানের বিভিন্ন সেকশনে নতুন করে ৬ হাজার ৫২০ টি বিভিন্নগাছের চারা রোপন করে ৩ বছর পরিচর্যা করেছেন। রেঞ্জ কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিবেদন পাওয়ার পর সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গত ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক অর্থাৎ জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটিকে গাছ বিক্রির অনুমোদনের বিষয়ে পত্র প্রদান করেন।
তৎকালীন জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ হোসেন গত ২০২৩ সালের ২১ মার্চ তারিখে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে ঝিমাই চা বাগানের ভূমি হতে গাছ কর্তন ও স্থানান্তর সংক্রান্ত বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রায় যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা, চা বার্ড এর অনুমোদিত তফশিলের লিজভুক্ত ভূমিতে প্রাকৃতিক গাছের সংখ্যা নির্ধারন করার বিষয়গুলো সরেজমিনে পরিদর্শন ও যাচাই বাচাই করার জন্য কুলাউড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে প্রধান করে এবং পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের প্রতিনিধি ১ জন ও বন বিভাগের কুলাউড়া রেঞ্জ কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে ৩ সদস্য কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কিন্তু উক্ত কমিটি গত ১০ মাসেও মাঠে তদন্ত করতে পারেনি। সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কুলাউড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মোঃ রিয়াজুল ইসলাম ও কুলাউড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন ঝিমাই চা বাগানে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও তদন্ত টিমের আহবায়ক মোঃ মেহেদী হাসান জানান, তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
এদিকে তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরদিন অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমদকে ঝিমাই চা-বাগানের অভ্যন্তরে পুঞ্জিতে খাসিয়ারা নিয়ে আসেন তাদের প্রতি মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে এ অভিযোগ দিয়ে। তারা পুঞ্জি পরিদর্শন করে পুঞ্জির হেডম্যান রানা সুরং ও চা বাগান ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামানেরও কথা শুনেন। এসময় ড. কামাল উদ্দিন আহমদ চা বাগান ও খাসিয়ারা স্থায়ী সমস্যা নিরসনের জন্য একটি উপায় বের করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
ঝিমাই চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, খাসিয়াদের নানা টালবাহানার কারণে গত ১৫ বছর থেকে বাগানের পরিপক্ক গাছ বিক্রি করা যাচ্ছেনা। চা-বোর্ডের অনুমোদন, উচ্চ আদালতের রায়কে অমান্য করে মানবাধিকারের কথা বলে নানা টালবাহানা করে বিভিন্ন জনকে এনে উসকানি দিয়ে এবং সময়ক্ষেপণের কারনে পরিপক্ক গাছগুলি মরে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাগানের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে এবং সরকারও প্রায় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, পুঞ্জির লোকজন চা বাগানের লিজভুক্ত ৩৭১ একর জায়গা দীর্ঘদিন থেকে জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে। কিন্ত প্রতিবছর চা বাগানের সম্পূর্ণ জায়গার জন্য তারা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে যাচ্ছে।ঝিমাই খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান রানা সুরং বলেন, তারা দীর্ঘদিন থেকে ঝিমাই পুঞ্জিতে বসবাস করে আসছেন। তারা গাছ রক্ষা করে এবং পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
প্রাকৃতিক গাছ কাটলে খাসিদের জীবিকায় আঘাত হানবে এবং পরিবেশের ভারসাম্যর বিরাট ক্ষতি হবে। তিনি আরো বলেন, চা বাগান কর্তৃপক্ষ গাছ কাটার আড়ালে মূলত: আমাদেরকে উচ্ছেদের পায়তারা করছে।’ বাগান কর্তৃপক্ষ রাস্তা দিয়ে গাড়ী চলাচল করতে বাঁধা দ”েছি। বন বিভাগের কুলাউড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ রিয়াজ উদ্দিন বলেন, বাগান কর্তৃপক্ষের সৃজিত এবং প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া গাছ ২০২২ সালে বাছাই করে কাটার জন্য অনুমোদনকৃত গাছ চিহ্নিত করার কাজ শেষ হয়। বর্তমানে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করছে। তদন্ত কমিটির কাজ শেষ হলে প্রতিবেদন তৈরি করে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হবে। এর পর সেটি জেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভায় অনুমোদন হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সর্বশেষ আপডেট: ১ মার্চ ২০২৪, ০২:৫৫
পাঠকের মন্তব্য