হাওরে অবাধে শিকার হচ্ছে অতিথি পাখি !

ছবি মুক্তিবাণী
ছবি মুক্তিবাণী
মৌলভীবাজার প্রতিনিধিঃ

হাওর বেষ্টিত মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি, কাউয়াদীঘি, হাইল হাওর, বাইক্কাবিল সহ ছোট-বড় প্রায় ৮টি হাওর। প্রতিবছর শীতের শুরুতে হাওরগুলোতে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। 

শীত প্রধান দেশগুলো থেকে উষ্ণতার খুঁজে ও খাবারের সন্ধানে তারা আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয় হাকালুকি সহজেলার বিভিন্ন হাওরকে। জীবন রক্ষা করতে এসে বিষ টোপে ও শিকারিদের পাতানো জালের ফাঁদে অবাধে মরছে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি।

হাকালুকি হাওরের ছোট বড় ২৭৩ বিল, ১০ নদী ও অসংখ্য খাল রয়েছে। এই সমস্ত বিল ও নদী অতিথি পাখিদের নিরাপদ খাবারের স্থান। কিন্তু স্থানীয় শিকারিরা বিভিন্ন কৌশলে অবাধে পাখি শিকার করে যাচ্ছে। হাকালুকি হাওরের শিকারিরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে হত্যার নিষ্ঠুর ও কুৎসিত পথ বেছে নিয়েছেন বিষটোপ!

কাউয়াদিঘী হাওরে প্রকাশ্যে জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করছে শিকারিরা। এছাড়া বিভিন্ন হাওরে স্থানীয় শিকারিরা বিভিন্ন কৌশলে প্রতিনিয়ত পাখি শিকার করার খবর পাওয়া যাচ্ছে।মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরের জুড়ী অংশের নাগুয়া ও চাতলার বিলে পাখি দেখতে ও ছবি তোলার জন্য আসেন ৩ আলোকচিত্রি।

তাঁরা হলেন সৈয়দ আব্দুল, শাহানুল করিম চপল ও মো. রিজওয়ানুল করিম। তারা হঠাৎ দেখেন নাগুয়া বিলে ৩২ টি হাঁস পাখির মৃতদেহ। আশেপাশে একটি দুটি করে ধুকে ধুকে মরছে আরো কয়েকটি পাখি। এগুলো বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি পিয়াং হাঁস ও উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস।

সরেজমিন জেলার রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরে গেলে দেখা যায়, হাওরের গিরিম, লামা মিটুপুর, দলিয়া ও পিয়ালা সহ হাওরের চার পাশে শিকারিরা পাখি শিকারের জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে রেখেছেন।

এসময় স্থানীয়রা বলেন, রাতে পাখিরা খাবার খেতে এসে এইসব জালে আটকা পরে। সকালে শিকারিরা জাল থেকে পাখি ছাড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করে।

তারা আরও বলেন, শিকারিরা দল বেঁধে বিষটোপ ও জাল দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার করছে। তারা সেসব পাখি গোপনে চড়া দামে বিক্রিও করছে। তবে শিকারিরা দুশ্চরিত্র লোক থাকায় ভয়ে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে পারছেন না। চাতলা বিলের ইজারাদার হাবিবুর রহমান বলেন, হাকালুকি হাওরে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। আগে অনেক পাখি দেখতাম এবার এসব চোখে পড়ছে না।

হাওরে পাখি কিনতে পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইলে স্থানীয় একজন বলেন, ‘হাকালুকি হাওরের পাখির অনেক দাম। ২টা হাঁস পাখি ১৬’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আবার কেউ কেউ অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন। আপনার লাগলে অর্ডার দিতে পারেন। তবে শর্ত হলো কেনার সময় একা আসতে হবে।’

পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের সদস্য খোর্শেদ আলম বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২ অনুযায়ী যে কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার, ক্রয়-বিক্রয় ও নিজের দখল বন্দী করে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শীত মৌসুমে একটি কুচক্রী মহল পাখি শিকারের মতো নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এপিডেমিওলজি ও শৌখিন বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম বলেন, ‘হাকালুকি হাওরের নাগুয়া ও চাতলার বিলে পাখি দেখতে এবং ছবি তোলার জন্য গিয়েছিলাম। তখন আমরা নিজের চোখে বিলের মধ্যে মৃত পাখি দেখে হতভম্ব হয়ে যাই।’

একদিকে জীব বৈচিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এইসব বিষযুক্ত পাখির মাংস খেয়ে সাধারণ মানুষ স্নায়ু, কিডনী, লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে এমনকি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। বয়োবৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের বেলায় এই ঝুঁকি অনেকগুণ বেশি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যার বিষয়টি আমার নজরে আসলে আমি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আইন শৃঙ্খলা সভায় এসব বিষয়ের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। এই বিষ কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়। এই সুযোগে শিকারিরা পাখি হত্যার কাজে ব্যবহার করে। আমরা অনুসন্ধান করে খুব দ্রুত এদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’

জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, ‘পাখি শিকারের বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি এবং জেলা আইন শৃঙ্খলা সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবগত করা হয়েছে। হাওরে যাতে কোনো দুষ্কৃতকারী কিংবা শিকারিরা অতিথি পাখি শিকার করতে না পারে। পাখি শিকার হচ্ছে এমন সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে অভিযান পরিচালনা করছি**।’

সর্বশেষ আপডেট: ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ২৩:২০
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও