তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, দেশবরেণ্য আইনজীবী, সাবেক এমপি, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন (৮৪) আর নেই। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ক্যান্সার আক্রান্ত মইনুল হোসেনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে কয়েকদিন আগে তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সন্ধ্যায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী আ.ন.ম ওয়াহিদুজ্জামান জানান, আজ (রোববার) সকাল সাড়ে ১০টায় বারিধারা জামে মসজিদে প্রথম জানাজা, বাদ যোহর সুপ্রিম কোর্টে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে তার বাবা-মায়ের পাশে দাফন করা হবে। মইনুল হোসেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের ইন্তেকালের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সুপ্রিম কোর্ট বারসহ গোটা আইনাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
বর্ষীয়ান এই আইনজীবী একাধারে ছিলেন আইনজীবী নেতা, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, সম্পাদক, লেখক, কলামিস্ট ও সম্পাদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পুত্র। তার আরেক ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু একজন রাজনীতিবিদ।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্রকামী, সাচ্চা জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ একজন আলোকিত মানুষ। ১৯৭৩ সালে পিরোজপুর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ বিলুপ্ত করে ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করলে এর প্রতিবাদে এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশের সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ’ (বিএনপি)’র সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে ২০০০-২০০১ মেয়াদে নির্বাচিত হন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তথ্য, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং ভূমি মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি মাসদার হোসেন মামলা এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পদত্যাগ করেন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ১৯৪০ সালের ৩১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তারপরে মিডল টেম্পলে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯৬৫ সালে বার এট ল’ সম্পন্ন করেন।
গ্রেফতার ও কারাবরণ : ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সরকার গঠন করলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এর সমালোচনায় মুখর হন। সভাসেমিনারে বক্তব্য প্রদান, টিভি টক শো এবং বিভিন্ন লেখালেখিতে সরকারের সমালোচনা করেন। এক পর্যায়ে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর মধ্যরাতে নারী সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তর জার্নালে করা একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ আনা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি ভাইরাল করা হয়। ফলে সারাদেশে তার বিরুদ্ধে অসংখ্য ‘মানহানি’র মামলা হয়। এ মামলায় ওই বছর ২২ অক্টোবর জাসদ (জেএসডি) আ স ম আব্দুর রবের উত্তরার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ৩ মাসের বেশি সময় কারাভোগ করে ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়েরকৃত মামলায় হাজিরা দিতে গেলে সরকার সমর্থক নারীকর্মীদের দ্বারা তাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়।
সর্বশেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৪৩
পাঠকের মন্তব্য