‘আমাদের অর্থনীতি, দেশের ভবিষ্যৎ, পোশাক শিল্পসহ অনেক কিছুই রক্ষা করতে হলে নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার এবং ক্রেডিবল করতে হবে’ (সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল)। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যখন জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে তখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেই সিইসি সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেছেন, বিদেশিরা নির্বাচনটা ফ্রি, ফেয়ার এবং ক্রেডিবল চাচ্ছেন। এই চাওয়া বেশি চাওয়া নয়। অন্যদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এই মুহূর্তে অর্থনীতি একটি অকার্যকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক করা কঠিন হবে। যেনতেন নির্বাচন করা হলে অর্থনীতি এবং স্থিতিশীলতা ও বেগবানের বদলে ভেঙে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিরা মুখ ফিরিয়ে নেবে।
শুধু সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল আর সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যই নয়, দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীরা আগামীর অর্থনীতির ভয়াবহতা তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকশ করেছেন। তাদের মতে, এমনিতেই ডলার সংকট, নতুন বিনিয়োগ নেই। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশিরা মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশের অর্থনীতি খাদে পড়ে যাবে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই ডায়ালগের আয়োজন করে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজনৈতিক সংহিসতা নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রবাদে রয়েছে ‘বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা অনেকটা তেমনিই। বাইরে ব্যাপক উন্নয়ন এবং কর্মযজ্ঞ দেখা গেলেও নতুন বিনিয়োগ এবং কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতিতে দিশেহারা মানুষ। গত কয়েক বছরে অনেকগুলো মেগাপ্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও দেশের অর্থনীতি কার্যত খাদের কিনারে চলে গেছে। ডলার সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্য আগে থেকেই স্থবির। এর মধ্যে হরতাল-অবরোধের মধ্যে পাতানো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দেড় বছর ধরে চলা ডলার সংকট এখনো কাটেনি। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে গত সেপ্টেম্বরে আমদানি খরচ কমে হয়েছে ৫২৭ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এখনো ঋণপত্র খুলতে চাহিদামতো ডলার পাচ্ছেন না। আবার অনেক উদ্যোক্তাকে ঘোষিত দামের চেয়ে ১২ থেকে ১৩ টাকা বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এদিকে গত অক্টোবরে রফতানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ১৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৩৭৬ কোটি ডলার। তবে গত মাসে প্রবাসী আয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এসেছে ১৯৭ কোটি ডলার।
জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করছেন। এতে করে বর্তমানে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে। উপরন্তু, স্বল্পমেয়াদি ক্রেডিট এবং ট্রেড ক্রেডিটও প্রতিকূল। আমাদের বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় তিন বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ বলেছেন, চারটি বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যা আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, বৈশ্বিক ও দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির অবস্থা এমনিতেই খারাপ। এর মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। ডলার সংকটের কারণে এমনিতেই বিনিয়োগ কমে গেছে। অস্থিরতা চলতে থাকলে বিনিয়োগ আরো কমবে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। এর মানে হচ্ছে, বিনিয়োগও কম হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সন্তোষজনক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এসব না থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ না বাড়লে গতিশীল হবে না অর্থনীতি।
বাংলাদেশ কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ নয়। এখনো আমদানিনির্ভর। অথচ বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন (১৬০০ কোটি ডলার) ডলারের কম। সরকার দাবি করছে এ ডলারে তিন মাস আমদানি করা যবে। আইএমএফের ঋণ নিয়েও ডলার সংকটের সুরাহা হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের সংকটে সময়মতো এলসি খুলতে না পারায় ব্যবসা চরম ক্ষতির হচ্ছে। বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ নেতা ও গার্মেন্টস মালিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে গার্মেন্টস পণ্য বিক্রি কমে গিয়ে পোশাক শিল্পে ধ্বস নামবে।
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশ আজ গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আসন্ন নির্বাচন একতরফা হলে দেশের সংকট আরো বাড়বে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং একদলীয় নির্বাচন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আরো বাড়াবে। কারণ বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ একটি সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়, যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যও খুব প্রয়োজন। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষ দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা সহ্য করে আসছে, অথচ মহামারির পর এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও অনেক দেশ এক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। আসন্ন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে বৈশ্বিক শক্তি মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং দেশ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবে।
জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বদলে দলীয় সরকারের অধীনে পাতানো নির্বাচনের পথে হাঁটতে শুরু করায় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে বহুমুখী সংকটে পড়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। গত ১৪ নভেম্বর এফবিসিসিআই কার্যালয়ে বিরাজমান বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, বিলাসী পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, এলসিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতীয় অর্থনীতিকে শঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষের বিদ্যমান পরিস্থিতি দেশের সরবরাহ ব্যবস্থাকে (সাপ্লাই চেইন) ভীষণভাবে বিঘ্নিত করছে। যার প্রভাব পণ্যের উৎপাদন, বাজার মূল্য এবং রফতানি ও সেবা খাতের ওপরও পড়ছে। কল-কারখানা ঠিকমতো না চললে আমদানি-রফতানি মুখ থুবড়ে পড়বে, সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। ডায়ালগে অংশ নিয়ে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ডলারের ওপর চাপ কমাতে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আরো সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কাটছাঁটের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে তা কমে হয়েছে ২ হাজার ৫১৬ কোটি ডলার (২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার)। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ১ হাজার ৯৫২ কোটি ডলার (১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার)। গত বুধবার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এই রিজার্ভের পুরোটা ডলার ব্যবহারযোগ্য নয়। আইএমএফও সঠিকভাবে রিজার্ভের হিসাবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, রিজার্ভ এখন যে পর্যায়ে নেমেছে, তা সংকটজনক না হলেও উদ্বেগজনক। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের আমদানি দায় মেটানো যাবে। এটাও ধরে রাখা হয়েছে জোর করে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। তা না হলে আরো কমে যেত। বিভিন্নভাবে দেশের অর্থপাচার হচ্ছে। পাচারের অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগে সরকার সফল হয়নি এবং পাচারও ঠেকাতে পারেনি। ফলে অর্থনীতিতে সংকট এখন বহুমুখী। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই সংকট সহসা কাটার সম্ভাবনা নেই।
গত ৬ নভেম্বর দেশের অর্থনীতির বেহাল চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। আমার ৩৬ বছরের সিভিল ও পাবলিক সার্ভিসে আমি কখনোই এমন অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি। আমার কর্মজীবনে দুই ধরনের ঘাটতি দেখেছি; তা হচ্ছে- চলতি হিসাবের ঘাটতি ও রাজস্ব ঘাটতি। একই সাথে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি হতে কখনোই দেখিনি। তবে তিনি মনে করেন পরিস্থিতি একেবারে তলানীতে নেমে এসেছে। আর খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এমনিতেই অর্থনৈতিক চাপ চলছে, তার ওপর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটা বলার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা সংঘাতময়, কতটা ব্যাপক, গভীর ও কতটা স্থায়ী হয়, তার ওপরই নির্ভর করবে আর্থিক ক্ষতি কতটা হবে। তবে স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সব পক্ষের আন্তরিকতা দরকার। কেননা ২০১৪ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংস্থা থেকে বলা হয়েছিল, সে সময়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল।
সর্বশেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০১:৫৯
পাঠকের মন্তব্য