সাজানো নির্বাচনে নাগরিক উৎকণ্ঠা সিরিয়ার পথে সরকার?

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিবাণী অনলাইন ডেক্স :

সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ মডেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। এক দশক আগে মধ্যপ্রাচ্যে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হয়েছিল। তখন জন বিক্ষোভের মুখে অনেক শাসক, যারা দশকের পর দশক শাসন করেছেন, তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। ব্যতিক্রম ছিল সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকার। তিনি আগেই আর্মি নামিয়ে দিয়েছিলেন। যেসব হাব-ভাব দেখছি, তাতে বিজিবি এখন ঢাকা শহরে টহল দিচ্ছে। র‌্যাব ঢাকায় টহল দিচ্ছে। ক’দিন পর হয়তো সেনাবাহিনী টহল দিতে নামানো হবে।

সুপ্রিম কোর্টকেও এখন ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করা হয়েছে। অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে এখন যতটুকুন কথা বলছি ৭ জানুয়ারির পর সেটিও বলা সম্ভব কি না সন্দেহ। এমপিকে স্বপদে বহাল রেখে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা! ওসি-টিএনও এমপির কথা শুনবেন নাকি অন্য প্রতিদ্বন্দ্বির কথা শুনবেন? এর মধ্যে গণতন্ত্রের ‘গ’ও নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এমন উৎকণ্ঠাই ব্যক্ত করলেন বিশিষ্ট জনেরা। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় ‘মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি’ আয়োজিত ‘আবারো সাজানো নির্বাচন : নাগরিক উৎকণ্ঠা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এমন উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেন তারা। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)’র নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক, তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে ড. শাহদীন মালিক বলেন, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশের সময় গেটে আমার গাড়ি থামানো হয়েছে। গাড়িতে সুপ্রিম কোর্টের পরিচয় সংবলিত স্টিকার থাকা সত্ত্বেও আমার গাড়ি থামানো হয়েছে। আমার শরীরে আইনজীবীর কালো গাউন থাকার পরে আমাকে দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। আমার জুনিয়র আইনজীবীরা বলছেন নিরাপত্তার নামে তাদের কাগজপত্র পোশাক সব পরীক্ষা করা হয়। এটা শুধু সুপ্রিম কোর্টের অবস্থা নয়। সারাদেশেই একই অবস্থা হয়তো বিজিবি, আনসার, পুলিশ, র‌্যাব এসবের সংখ্যা ১০-১২ লাখের মতো প্রায়। এরশাদ আমলে এতো সংখ্যক ছিল না। এমন পরিস্থিতি ছিল না।

তিনি বলেন, আদালতের মূল কথা হলো, একমাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। আমরা তিন জনে বসে যদি কারো ইন্টারভিউ নিই। একজনের পর আরেকজনের ইন্টারভিউ নিয়ে যাই। এটি কিন্তু একটি গোপন কক্ষে হয়। ন্যায় বিচারের একমাত্র গ্যারান্টি হচ্ছে পাবলিক ওপেন প্যাসেজ। ১৫/২০ জন লোক যদি কোর্টে থাকে তারা দেখেশুনে বুঝতে পারে। একটু চিন্তা করে দেখি, আমরা যেটিকে বলি আরব স্প্রিং। এক যুগ আগে যেটি তিউনিশিয়া থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন আরব দেশে শাসক ছিলেন দশকের পর দশক। বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভের জোয়ার যখন এলো তখন অনেকেই পদত্যাগ করে চলে গেলেন। কিন্তু বিক্ষোভের পর সিরিযার প্রেসিডেন্ট আসাদ থেকে গেলেন। এটি অন্য মডেল। এক মডেল হলো জনবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছে। আসাদের মডেল ছিল সে, আগেই আর্মি নামিয়েছিলেন। এখন এ মুহূর্তে বোধ হয় ৬০/৬৫ লাখ সিরিয়ান রিফিউজি হয়ে আছে। এখন যেসব হাব-ভাব দেখছি, বিজিবি এখন ঢাকা শহরে টহল দিচ্ছে। র‌্যাব ঢাকায় টহল দিচ্ছে। ক’দিন পর হয়তো সেনাবাহিনী টহল দিতে নামানো হবে। আমার কেন যেন মনে হয় জনবিক্ষোভ সরকার কীভাবে মোকাবিলা করে, এ নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। আমাদের সরকার আসাদ মডেলের সরকারে চলে যাচ্ছে। এটি নিয়ে আমি এখন হতাশ।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আগামি ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হবে। কী নির্বাচন হবে? খামোখাই গতকাল বন্ধুদের বলেছিলাম, জাতীয় পার্টি ২৯০টি সিটে মনোনয়ন দিয়েছে। কেন মনোনয়ন দিয়েছে আল্লাহই জানেন। হয়তো বিনিময়ে ভোট পাবে না, অন্যকিছু পাবে। যে এক্সারসাইজটা হবে, এটি হওয়ার পর অর্থনৈতিক দিক নিয়ে, রাজনৈতিক দিক নিয়ে কথা বলছি। এখনও যেটি আমরা বলছি। আগামি ৭ জানুয়ারির পর এটিও আমরা বলতে পারব কি না সন্দেহ আছে। বার বার বলছি, আমার মনে হয় সরকার ‘আসাদ মডেল’টা অ্যাড্পট করছে। আগে থেকে যেটা বলা হয়, গণআন্দোলনের ফলে এরশাদ সরকার চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

এই হিসেবগুলো কিন্তু আমরা কোথাও পাই না। আমার যেটা মোটামুটি ধারণা, এখন আনসার আছে ৭ লাখ। পুলিশ সব মিলিয়ে বোধ হয় ২ লাখ। মোট ৯ লাখ, র‌্যাব আছে ১৩ হাজার। সেনাবাহিনী কত আছে জানি না। ২ লাখ হবে হয়তো। সব মিলিয়ে স্টেট এর ‘ফোর্স অব ভায়োলেন্স’। এটি অবশ্যই ১০ থেকে ১২ লাখ লোক। এটি এরশাদের আমলে দেড় লাখ থেকে ২ লাখ ছিল। যদি এই ১২ লাখ লোককে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে, জীবনের তোয়াক্কা না করে আপনার স্বার্থ রক্ষার জন্য নির্দেশ দেবেন এবং তাদেরও মন-মানসিকতা হয় কোনটি উচিত কোনটি উচিত নয়Ñ সেটি না ভেবে করলে এই রকম একটা সরকার যখন ১০ লাখ লোকের বেশি ফোর্স অব ভায়োলেন্স মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন, তাহলে খুবই খারাপ দিকে যাচ্ছি।

একটি জিনিস এতোদিন গর্ব করে বলতাম। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। এখন ডেফিনেটলি ওইদিন সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে। সরকার কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানে কিন্তু বলা আছে, মেয়াদপূর্তির আগে যেকোনো মুহূর্তে সংসদ ভেঙে দেয়া যায়। আমাদের সংবিধানে এটি আছে। বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে দিলে তার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। এটিতো অ্যাবসার্ট। আমি যখন সিটিং এমপি তখন ওসি আমার কথা শুনবে নাকি প্রতিদ্বন্দ্বির কথা শুনবেন? টিএনও আমার কথা শুনবে নাকি এমপির কথা শুনবেন? এটিতো গণতন্ত্রের ‘গ’ও হয় না।

সংক্ষেপে যেটা বলছিলাম, থিওরিটিক্যালি প্রধানমন্ত্রী ডিসেম্বর মাসে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। তখন আরো ৩ মাস সময় নিতে পারেন। তাহলে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে। এক ধরনের লোক সংসদে থেকে নির্বাচন করছেন। আরেক দল লোক সংসদে না গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাহলে আর অসম প্রতিযোগিতা হবে না।মূল প্রবন্ধে ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে নির্বিচারে মামলা দায়ের, বিচারিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাজা প্রদান ও নির্যাতনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় বিএনপির অংশগ্রহণের সুযোগ রুদ্ধ করছে।

তিনি বলেন, এ কাজে পুলিশ, জনপ্রশাসন, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে সরকার। নির্বাচনের এই আয়োজন এমনকি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের চেয়েও নগ্ন, বেপরোয়া ও উদ্ধ্যত। এই নির্বাচনের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অথনৈতিক ও সামাজিক সংকট ঘনীভূত হবে। এর সমর্থনকারী দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে আরও বেশি অন্যায্য সুবিধা নেয়ার সুযোগ পাবে।

ড. আসিফ নজরুল তার মূল প্রবন্ধে এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়ার কিছু নতুন মাত্রা উল্লেখ করে বলেন, ২০১৮ সালে দায়েরকৃত গায়েবি মামলার অস্বাভাবিক গতিতে বিচার কার্যক্রম চলছে। গত ৩ মাসে ৩৪টি মামলায় ৫৮৪ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এ ধরনের আরো শতাধিক রায় যেকোনো দিন ঘোষণা হতে পারে। উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্তের কারণে বিচারিক আদালতে শাস্তি পাওয়া বিএনপির নেতারা চাইলেও নির্বাচন করতে পারবেন না। পুলিশকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে শাস্তি নেয়া হচ্ছে। ঘটনার বিবরণ তারতম্য থাকলে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রসিডিং শুরু হবে। অধিকাংশ মামলায় শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে। তৃতীয় ট্রেনড হচ্ছে, কেবলমাত্র পুলিশ সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে এসব শাস্তি হচ্ছে। দ্রুত বিচারে বিএনপির মৃত এবং দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের সাজা দেয়া হচ্ছে। চতুর্থ ট্রেনড হচ্ছে, পুরোনো মামলা দায়েরের পাশাপাশি নতুন করে মামলা করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ২৫ লাখ বিএনপির নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর হামলা-মামলা নতুন গতি পায়। বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সারাদেশে ৩৮৪টি মামলায় ১৫ হাজার ৬শ’ নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হয়। হোসেন জিল্লুর রহমান একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন, ২৮ অক্টোবরের পর একতরফা নির্বাচন করার মানসকিতা জোরদার হয়েছে।

যদি তুলনা করি, পুলিশ একজন বা দুই জন পুলিশ মারা গেছে। সাধারণ মানুষ মারা গেছে ১৬ জন। বিএনপির আহতের সংখ্যাও বেশি। পুলিশের পাশাপাশি মুখোশ পরে সরকারদলীয় ব্যক্তিরাও হামলা করেছে। বিএনপির লোকেরা যে মারা গেল, তাদের ঘর-বাড়িতে হামলা হলো। এসব ঘটনায় বিএনপির পক্ষে কোনো মামলা দায়ের আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি। গায়েবি মামলায়ও বিএনপির নেতাকর্মীরা জামিন পাচ্ছে না। সব মামলার একই রকম রিপোর্ট। দুর্বল ভিত্তি। বিচারিক আদালত জামিন দিচ্ছে না। বরং রিমান্ডে পাঠানো হচ্ছে। পঞ্চম ট্রেনড হচ্ছে, বিএনপি নেতাদের বাড়ি বাড়ি হামলা। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের না পেয়ে স্বজনদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ৯৩ জন বিএনপি নেতার বাসায় হামলা হয়েছে।

৬ষ্ঠ ট্রেন্ড হচ্ছে, কিংস পার্টি গঠন। নির্বাচনে কৃত্রিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টির জন্য বিএনপি থেকে বহিষ্কৃতদের দিয়ে কিংস পার্টি গঠন করা হয়। তারা রাতারাতি নিবন্ধন পেয়ে যায়। বিএনপির কাছাকাছি নাম ও প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রধান দল জাতীয় পার্টিকেও চাপ দেয়া হয়।

৭ম ট্রেনড হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত ভূমিকা। কমিশন কিংস পার্টিকে প্রণোদনা দিচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলার পরপরই তফসিল ঘোষণা করে। বিরোধী নির্যাতন বন্ধে কমিশন তার ক্ষমতা প্রযোগে অনীহা থাকে। আগামি নির্বাচনকে সামনে রেখে জেল-জুলুমের মাধ্যমে সরকার দ্রুত লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে।

সর্বাত্মক দমন-পীড়ন নীতি অবলম্বন করেছে। বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করা হয়। প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের গতিকে ধুলিসাৎ করা। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে সরকার। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার আমাদের মনোপুত না হলেও, নির্বাচন কমিশন সবচেয়ে শক্তিশালী। তাদের উচিত হবে অনৈতিক ও অযৌক্তিকভাবে যাদের রাজবন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয়েছে তাদের মুক্তি দেয়া, যাতে করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। নির্বাচনী তফসিল পুনঃনির্ধারণ করা, কেননা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে নির্বাচন মেনে নেয়া যাচ্ছে না। গণতন্ত্র মানে আলোচনা এবং আলোচনার সুযোগ দিতে হবে। সুসংগঠিত হয়ে সকলকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে।

সর্বশেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০১:৫৪
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও