সবুজের মাখামাখি এলাকা মৌলভীবাজার। তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া অনেক জাতি-গোষ্ঠির বসবাস এই এলাকায়। চা অধ্যুষিত জনপদ হওয়ায় মৌলভীবাজারের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে চা-শ্রমিকের বসতি। চা-শ্রমিকের সন্তানেরা দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষা-দীক্ষায় রয়েছে পিছিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে এসব অসহায় হতদরিদ্র চা-শ্রমিক পরিবারের শিশু সন্তানদের জন্য এমসিডা ‘আলোয় আলোয়’ প্রকল্প শিশুদের মান-সম্পন্ন প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করে দিয়েছে। ফলে চা বাগানে পিছিয়েপড়া পরিবারের শিশু সন্তানরা লেখাপড়ায় আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে ও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের জন্য গড়ে ওঠা ‘আলোয় আলোয়’ প্রকল্প-এর রাজঘাট চা বাগান হাসপাতাল মাঠের এক পাশে শিশুকানন প্রাক শৈশব বিকাশ কেন্দ্রের আলো ছড়ানোর ফলে পূর্বের চিত্র পাল্টে গেছে। রাজঘাট চা বাগানের শিশুরা পড়াশোনা করে, সময়মতো স্কুলে যায়। শুধু রাজঘাট চা বাগান নয়, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার চা-বাগান ও হাওর এলাকার মোট ১৩০টি ইসিডি (আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট) সেন্টারে ৫ হাজার ২৭৬ জন শিশু প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। এসব এলাকায় ১১টি ডে কেয়ার সেন্টার চালু রয়েছে। সেখানে ৩১৮জন ২-৩ বছর শিশু রয়েছে।
২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের ২০২৩ সাল পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের ৩০টি চা-বাগান ও ২টি হাওর এলাকায় চাইল্ডফান্ড কোরিয়ার অর্থায়ন ও এডুকোর সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স, আইডিয়া, এমসিডা ও প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন করছে আলোয় আলোয় প্রকল্প।
যেসব এলাকায় এই প্রকল্পের কার্যক্রম হয়েছে যেমন শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালীঘাট ইউনিয়ন, আশিদ্রোন ইউনিয়ন, রাজঘাট ইউনিয়ন, মির্জাপুর ইউনিয়ন, সাতগাঁও ইউনিয়ন, কালাপুর ইউনিয়ন, সিন্দুরখান ইউনিয়ন। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়ন, ইসলামপুর, আলীনগর, কমলগঞ্জ, রহিমপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চা বাগান এলাকায়।
প্রকল্প সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রকল্প থেকে চা- বাগানের লেবার লাইনে ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য একটি পাকা অবকাঠামো, স্থানীয় শিক্ষক, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ, শিশুকানন পরিচালনার যাবতীয় উপকরণ, শিশুদের শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়। বাগান পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিভাবক কমিটি শিশুকাননগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়মিত মনিটরিং করে থাকেন। শিশুদের মা-বাবাকে গুড প্যারেন্টিং সেশন, পুষ্টিসেবা, বসতবাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এই প্রকল্প থেকে। শিশুরা আনন্দের সাথে লেখাপড়া করছে।
এছাড়াও শিশুদের এবং তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, শিশু অধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্যোগের বিরুদ্ধে শিশুদের দুর্বলতা হ্রাস করা। সরকারের কাছ থেকে প্রাসঙ্গিক সম্পদ সংগ্রহ করা। এবং চা বাগান কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সহযোগিতা এবং নেটওয়ার্ক জোরদার করার মাধ্যমে সরকারকে নিশ্চিত করতে।
প্রকল্পটি মিশন বাস্তবায়নের জন্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে যেমন সরকারী কর্তৃপক্ষ, চা বাগান কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ এবং চা বাগানের পঞ্চায়তের সাথে সভা সেমিনার মাধ্যমে নানা পরামর্শ গ্রহন করে যুব ও কিশোরী ক্লাব, কাজ করার জন্য একটি যৌথ দল গঠন করে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করে। ফলে এই সময়ের মধ্যে শিশুদের শারীরিক বাস্তবায়ন পাঠ এবং ইসিডি এবং ডে কেয়ার সেন্টারে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা করে। ওই দুটি উপজেলায় ৩২টি কিশোর ও যুব ক্লাব রয়েছে। সেখানে ক্লাবের সকল সদস্য ত্রৈমাসিক সভায় অংশগ্রহণ করে এবং তাদের বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবদান রেখেছে। ওই ক্লাবের কিশোর ও যুবদলের সদস্যরা মিলে মোট ২ হাজার ৩৪৬ শিশু জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
তাছাড়া ৩২টি শিশু সুরক্ষা কমিটি শিশু সুরক্ষা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে ৮টি সচেতনতামূলক প্রচারণার করে যাচ্ছেন। কমিটির সদস্যরা কমিউনিটি পর্যায়ে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে তাদের কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।
এছাড়াও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমর্থিত ৩২টি স্কুল শিক্ষকের জন্য প্রাথমিক এবং রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেখানে ২০২২ এবং ২০২৩ সাল, দুই বছরে ৩২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ হাজার ২৫৯ জন শিশুকে শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। জঙ্গলবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি মডেল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাতগাঁও চা বাগানে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় সমতা শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাগত উপকরণ কেনা হয়েছে। এডুকোর আলোচনায় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরামর্শে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করা হয়।
রাজঘাট শিশুকাননের সহায়িকা কহিনূর আক্তার বলেন, শিশুরা আগে পড়াশোনায় তেমন আগ্রহী ছিল না। এখানে ইসিডি সেন্টার খোলার পর আমরা সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস করাই। শিশুরা এখানে খেলাধুলা ও ছড়াগানের মাধ্যমে প্রাক- শৈশবের উপযোগী শিক্ষা অর্জন করছে। খেলাধুলার সামগ্রী ও রংতুলি-রংপেনসিলের ছোঁয়ায় তাদের লেখাপড়ায় আরো আগ্রহ বেড়েছে। নানা ফুল, পাখি, প্রজাপতি আঁকা এই সুন্দর শ্রেণিকক্ষে আসার জন্য শিশুরা উন্মুখ হয়ে থাকে। পাশাপাশি তাদের মা- বাবাও নিশ্চিন্তে শিশুটিকে রেখে চা বাগানে কাজে যেতে পারছেন।’ তাঁর অনুভূতি সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে ঘুম থেকে উঠতাম আটটার পর। এখন বাচ্চাদের জন্য ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠি, তারপর স্কুলে রওয়ানা হই। সব বাচ্চাদের ডেকে ডেকে আনি, তাদের সাথে থাকি। সকালটা আমার ভালই কাটে আমিও হাসিখুশিতে থাকতে পারি।’একই চা বাগানের মন্ডপের সামনে আরেক প্রতিষ্ঠানের সহায়িকা দীপ্তি তাঁতি একই কথা জানালেন তিনি।
তিনি বলেন, পাশাপাশি চা-বাগানের শিশুদের জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করতেও প্রকল্পের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিই। শিশুকাননের সব শিশুর যেন জন্মনিবন্ধন হয়, সেই বিষয়ে অভিভাবকদের নিয়মিতভাবে সচেতন করে থাকি।’
এমসিডা আলোয় আলোয় প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মো. রেজাউল করিম বলেন, চা বাগানের শিশুদের শিক্ষায় আলোকিত করেছি। আমাদের এই প্রকল্পে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৫৮৬ জন শিক্ষার্থী জন্ম নিবন্ধন হয়েছে। তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত মোটামুটি পঞ্চাশ পার্সেন্ট শিশু প্রি-প্রাইমারীতে ভর্তি করাতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সময়ন্বয়কারী,কর্মকর্তাবৃন্দ,প্রকল্পটিম এমসিডার ম্যানেজমেন্টসহ সকলের সহযোগিতায় আমরা এই ছোট্র ছোট্র ফুলকে বিকশিত করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে যাচ্ছি এটা আমাদের বিরাট গর্বের কাজ। বিশেষ করে সুবিধা বঞ্চিত বাগান এলাকায় শিক্ষার্থীদেরকে আনন্দিত করাটা, মনে করি অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ।’
এমসিডা আলোয় আলোয় প্রকল্পের প্রজেক্ট অফিসার মো. ফারুক আহমদ বলেন, এই প্রকল্পে কাজ তিনি খুবই আনন্দিত। বিশেষ করে ইসিডি সেন্টারে ২০/২৫জন শিশু বাচ্চারা আসে। ওদের যে আনন্দঘন মহুর্তে ওদের ছবি দেখা, শিখা, কবিতা, গল্প বলা ইত্যদি আন্দনঘন পরিবেশে যে শিখাটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। অন্যান্যদের বাচ্চাদের চেয়ে আমি মনে করি ইসিডি বাচ্চাদের চেলাফেরায় অনেক সচেতন হচ্ছে। অন্যান্য বাচ্চারা প্রি-প্রাইমারীতে ভর্তি হলে তাদের ভয় কাটে। ওরাও ছবি দেখে আনন্দঘন পরিবেশে গানবাজনা, কবিতা আবৃত্তি এগুলো শিখে জড়তা কাটে এবং তাদেরকেও স্বতস্ফুর্ত আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা দেওয়া হয়।’
মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার খোরশেদ আলম বলেন, চা বাগানের প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে আলোয় আলোয় প্রকল্প। এই কার্যক্রম থাকার কারণে সুবিধা বঞ্চিত চা শ্রমিক শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রনী ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে চা-বাগানের শ্রমিকদের শিশু সন্তানরা পড়াশোনায় মনোযোগি করে তুলছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি শিশুকানন, প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।’
সর্বশেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ০২:০৩
পাঠকের মন্তব্য