সীমা ছাড়িয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ভয়াবহ সঙ্কটে জীবনযাপন

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিবাণী অনলাইন ডেক্স :

দেশের বাজারে হু হু করে বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম। ফলে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা টাকার মান হারাচ্ছে। খোলাবাজারে খুচরা ডলারের দাম গিয়ে ঠেকেছে ১৩০ টাকায়। খোলাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৫-১৭ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। আর ডলারের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রায়। অবশ্য সর্বত্রই ডলারের প্রভাব পড়েছে। এমনতিইে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ খুঁজেন। যেমনÑ দু’-এক দিন বৃষ্টি হলে সেই অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়, আবার একনাগাড়ে কিছুদিন বৃষ্টি না হলে সেটাকেও দায়ী করা হয়। এতে করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কিনতে পারে না। তারা দিনের খাবার কমিয়ে দেন, মাছ, গোশত খাওয়ার বদলে শরীরের আমিষের চাহিদা মেটাতে ডিমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সে ডিমের দামও আকাশছোঁয়া।

জানা গেছে, ডলারের বাড়তি মূল্য প্রভাব ফেলছে বাজারে নিত্যপণ্যে। বিষয়টি একাধিক আমদানিকাররা বলছেন, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার পর ঘোষিত দরের চেয়ে বাড়তি দামে ডলার কিনে তাদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে বাজারে তেল, চিনি, ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এদিকে নতুন করে আবারও দাম বেড়েছে আটা-ময়দা ও পিঁয়াজের। গত প্রায় দুই বছরে ডলার সঙ্কটে টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে দেশে খাদ্য, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ঘন ঘন বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ছোট ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে এবং কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যা দেশের রাজস্ব আয়েও প্রভাব ফেলেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন খাতে আয়কর বাড়ালেও আমদানি বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা কর দিতে পারছে না। এছাড়া গত ৭ দিনে রিজার্ভ কমেছে ১১৮ কোটি ডলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছেÑ দেশের রাজনৈতিক সংকট, হরতাল-অবরোধ। যা দেশের জীবনযাত্রাকে ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের প্রভাব, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক সঙ্কটসহ নানাবিধ কারণে দেশে আজ আফ্রিকার দেশগুলোরে মতো দুর্ভিক্ষ না হলেও ওই দিকেই যাচ্ছে। ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে দেশ।

নিত্যপণ্যের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাস, বাড়িভাড়া, যাতায়াত ব্যয় বেশি মাত্রায় বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ এবং পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার বাড়তি ব্যয়। এসব ব্যয় মেটাতে সঞ্চয়ও শেষ। এমন অবস্থা দাড়াচ্ছে নিম্ন আয়ের ও মধ্যবিত্ত মানুষ বড় কোনো অসুখ না হলে চিকিৎসা নিচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের মূল্য যেভাবে হুঙ্কার দিচ্ছে সামনে আরও দুর্দিন আসছে। চলতি বছর সিপিডি এক সমীক্ষায় জানিয়েছে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষ খাবার কমিয়ে দিয়েছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বড় একটা অংশ গরুর গোশত, মাছ ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে।

যে ডিমের ওপর গরীবের আমিষ নির্ভরতা ছিল সে ডিমের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের একটা অংশ ডিম খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছে অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরের শর্করা, প্রোটিন ও আমিষের চাহিদা মেটানো না গেলে নানা ধরনের রোগব্যাধি হয়। এক দশক আগে আফ্রিকার দেশ জিবুতি, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ তীব্র খরা পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটে পড়েছিল। প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে মানুষ হাড্ডিসার হয় এবং দেশগুলো চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঠেকানো না গেলে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের একটা অংশ প্রয়োজনী খাদ্যের অভাবে নানান রোগ্যব্যাধিতে পড়ে যাবে।

দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতীয় অর্থনীতিকে শঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি দেশের সরবরাহ চেইনকে ভীষণভাবে বিঘিœত করছেÑ যার প্রভাব পণ্যের উৎপাদন, বাজার মূল্য এবং রফতানি ও সেবা খাতের ওপরও পড়ছে।

সূত্র মতে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতিকে ডাবল ডিজিটে ঠেলে দিয়েছে। এতে দেশের সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। খোলাবাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে চায় ব্যবসায়ীরা। দ্রুত মূল্য সমন্বয় করে দাম বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে চিঠি দিয়েছে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

রাজধানীর খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দু’দিনে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ৩-৫ টাকা, চিনির দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা এবং ডালের দাম কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৯ টাকা, খোলা তেল ১৪৯ টাকা এবং পাম তেল ১২৪ টাকা। এ ছাড়া চিনির দাম খোলা ১৩০ এবং প্যাকেটজাত ১৩৫ টাকা।

এদিকে পাইকারি ও খুচরা বাজারে বেড়েছে আটা ও ময়দার দাম। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আটার কেজিতে সর্বোচ্চ ১০ টাকা এবং ময়দার কেজিতে সর্বোচ্চ ছয় টাকা দাম বেড়েছে। ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে গম আমদানিতে খরচ বেড়েছে। ফলে বাজারে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।

এদিকে, ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার মৌলভীবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে ৫০ কেজি ওজনের আটার বস্তায় ২০০ আর ময়দায় বেড়েছে ৩০০ টাকা। এতে বাজারে খোলা আটার কেজি ৪৮ থেকে ৫০ এবং প্যাকেট আটার কেজি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে খোলা আটা ৪২ থেকে ৪৫ এবং প্যাকেট আটা ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে খোলা ময়দার কেজি ৫৫ থেকে ৬০ এবং প্যাকেট ময়দার কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। দাম বেড়ে এখন খোলা ময়দা ৬০ থেকে ৬৬ এবং প্যাকেট ময়দার কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ডলার সঙ্কটে চাল-গমসহ খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক কমিয়েও আমদানি বাড়ানো যায়নি। আবার শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, চাল, সার, ছোলা ভোজ্যতেলসহ জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে এলসি খোলা ধারাবাহিকভাবে কমছে। জুলাই মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের। আগের বছরে তা ছিল ৭ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। আগস্টে এলসি খোলা হয় ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের। আগের বছরে একই মাসে ছিল ৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা হয় ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের এবং আগের বছর তা ছিল ৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। এই হিসেব মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে শুধু ৩ মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে। সাধারণত একটি দেশে ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদ-ে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ। যদিও এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। তবে তা প্রকাশ করা হয় না। যে হিসাবে প্রকৃত রিজার্ভ আরও কম।

এদিকে শুধু নিত্যপণ্যেই নয়; ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। প্রতিবছর এই খাতে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। এমনকি হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্জিন দেয়ার পরেও এলসি খোলা যাচ্ছে না। আবার অনেক আমদানিকারক হয়তো কাঁচামাল এনেছেন, কিন্তু বন্দর থেকে সময়মতো খালাস করতে পারছে না। কারণ ব্যাংক এলসি নিষ্পত্তি করতে পারে না। ফলে অনেক কারখানায় ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণে ওষুধ উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাবে ওষুধের দাম বাড়ছে। আর এই দাম বাড়ার ঘানি টানতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলার সংকটে আমদানিতে কড়াকড়ি করায় এলসি খোলা কমেছে। তবু ডলার সংকট থেকে যাচ্ছে। এ জন্য নিষ্পত্তি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আমদানি পণ্য কমেছে, যা বাজারকে উসকে দিচ্ছে। সংকট কাটাতে শক্তিশালী রাজনৈতিক কমিটমেন্ট দরকার বলে মনে করেন তিনি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি করা পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। নিত্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস অবস্থা। সাধারণ-গরিব ও মধ্যবিত্তরা পড়েছেন চরম বিপাকে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ডলার সঙ্কটের প্রভাব সর্বত্রই। প্রতিদিনই বাড়ছে দ্রব্যমূল্যের দাম। আগামী দিনে দাম কমার সম্ভাবনা নেই। বরং আরও বাড়বে।

সর্বশেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০১:৫৩
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও