১২ বছর বয়সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুই হাত পুড়ে গেছে মুক্তামণির (১৫)। চিকিৎসকরা কনুই থেকে তার হাত দুটি কেটে ফেলেন। এরপরও ক্ষত ছড়িয়ে পড়ায় পুরোপুরি দুটো হাতই শরীর থেকে কেটে ফেলা হয় মুক্তামণির।
দুর্ঘটনার আগে মুক্তামণি সাভার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। ক্লাসে মেধাতালিকায় প্রথম ছিল সে। তবে ওই দুর্ঘটনাটি তার সব এলোমেলো করে দিয়েছে। অন্ধকার নেমে আসে মুক্তামণির জীবনে। তারপরও পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ তার। সেই আগ্রহ থেকেই কিছুটা সুস্থ হয়ে পা দিয়ে লেখা শুরু করে। একপর্যায়ে পা দিয়ে লেখার অভ্যাস হয়ে যায়। এভাবে লিখেই বাজিমাত করেছে মুক্তামণি। এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় (পিএসসি) জিপিএ-৫ পেয়ে সে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
মুক্তামণি বরিশালের হিজলা উপজেলার পূর্ব পত্তণীভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় এ সাফল্য পেয়েছে।
মুক্তামণি হিজলা উপজেলার পত্তণীভাঙ্গা গ্রামের সেন্টু সরদার ও ঝুমুর বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে বড়। সেন্টু সরদার ছয় বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তিন বছর ধরে কোনো কাজ করতে পারেন না তিনি। সংসারের হাল ধরতে হয় স্ত্রী ঝুমুর বেগমকে। তিনি সাভার ইপিজেড এলাকার একটি গার্মেন্টে কাজ করেন। তার একার উপার্জনেই চলে চারজনের সংসার।
মুক্তামণির মা ঝুমুর বেগম জানান, স্বামী সেন্টু সরদার সাভারে যাত্রীবাহী বাসে হেলপারের কাজ করতেন। সেই সুবাদে তারা সাভারেই থাকতেন। অভাব অনটন থাকলেও সংসার জীবনে সুখ ছিল। কন্যাসন্তান মুক্তামণিকে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেল। ছয় বছর আগে স্বামী সেন্টু সরদার বাসের নিচে চাপা পড়েন। এতে তার ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বামীর চিকিৎসা চালাতে অনেক টাকা খরচ হয়। ধারদেনা করতে হয় অনেক। কিছুটা ভেঙে পড়েন তিনি। তিনজনের সংসার চালাতে চাকরি নেন গার্মেন্টে। এরপর তিন বছরের মাথায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই হাত হারায় মুক্তামণি।
ঝুমুর বেগম বলেন, মুক্তামণির দুই হাত পুড়ে যায়। তার বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। মেয়ের চিকিৎসা চালাতে ভিটে-বাড়ির জমিটুকুও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে মুক্তামণি। তবে তার দুই হাত হারাতে হয়।
তিনি বলেন, মেয়েকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসি। সারাক্ষণ ওর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। একা শৌচাগারে যেতে পারে না। কাজে না গেলে দুবেলা খাবার আসবে কীভাবে। এ কারণে মুক্তামণিকে হিজলায় তার দাদা-দাদির কাছে রেখে আসি।
ঝুমুর বেগম বলেন, মুক্তামণির শিশুকাল থেকেই পড়াশোনার প্রতি খুব ঝোঁক। হাত না থাকায় সে পা দিয়ে লিখতে শুরু করে। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে ভর্তি করা হয় হিজলা উপজেলার পূর্ব পত্তণীভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পা দিয়ে লিখেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষায় প্রথম হয় মুক্তামণি। মঙ্গলবার পিএসসির ফল প্রকাশ হয়। জানতে পারি সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। মুক্তামণির এ সাফল্যে খুশি হয়েও বর্তমানে চরম দুশ্চিন্তায় আছি।
ঝুমুর বেগম বলেন, অভাব-অনটনের টানাটানির সংসারে মেয়েকে পরীক্ষার সময় ভালো একটি জামাও কিনে দিতে পারিনি। সে সক্ষমতা ছিল না আমার। পড়াশোনার জন্য এ বয়সেই অনেক কষ্ট করেছে মুক্তামণি।
মুক্তামণি জানায়, পা দিয়ে লেখা শেখানোর মূলে তার মা। তার জন্য মা অনেক কষ্ট করেছেন। মায়ের কাছ থেকে এবং সাহায্য নিয়ে প্রায় সব কাজই করতে শিখেছে সে। মুক্তামণি পড়ালেখা শিখে শিক্ষকতা করতে চায়।
পূর্ব পত্তণীভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আবু হানিফ জানান, অভাব আর প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মুক্তামণি যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। বিদ্যালয় থেকে এবার ১৪ জন পরীক্ষার্থী পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে মুক্তামণি পা দিয়ে লিখেই জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে এখন ওই গ্রামের দৃষ্টান্ত।
শিক্ষক মো. আবু হানিফ জানান, মুক্তামণির উচ্চশিক্ষার জন্য বড় বাধা অর্থনৈতিক সংকট। এখন তার সহায়তা প্রয়োজন। সরকারিভাবে বা সমাজের কোনো বিত্তবান ব্যক্তি এগিয়ে এলে মুক্তামণির মতো শিক্ষার্থীরা আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবে।
সর্বশেষ আপডেট: ২ জানুয়ারী ২০২০, ০১:০৯