শিশু শিক্ষার্থী নাঈম, গত ১৩ মাস ধরে আর দশটা শিশুর মতই সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুল ড্রেস পরে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যায়। কিন্তু সবাই ক্লাসে ঢুকলেও নাঈম মাথা গুজে দাঁড়িয়ে থাকে গেটের সামনে। এমন অভিযোগ উঠেছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দি বাডস্ রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, নার্সারি ওয়ানের শিক্ষার্থী নাইমকে ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্কুলে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষার্থী নাইমের বাবা আবদুর রহমান জানান, তার দুই পুত্রকে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দি বাডস্ রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা মিডিয়ামে নার্সারি ওয়ানে ভর্তি করান এবং নাইম জুন মাস পর্যন্ত ক্লাস করে। একই বছর ২৮ জুন তাকে আবার একই প্রতিষ্ঠানের ইংলিশ মিডিয়ামে নার্সারি ওয়ানে নতুন করে পুনরায় ১০ হাজার টাকা ভর্তি ফি দিয়ে তিনি ভর্তি করি। একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর নাইমকে স্কুলের উপযোগী নয় বলে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে স্কুল ড্রেস পরিধান করে স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলের গেট পর্যন্ত নাইমের ভাইয়ের সাথে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে আসি। কিন্তু স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারের নিষেধাজ্ঞার কারণে গেটের দারোয়ান আমার ছেলে নাইমকে স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ দিচ্ছে না।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আব্দুর রহমান বলেন, তার সহপাঠীরা যখন ক্লাস করে তখন প্রতিদিন আমার শিশু ছেলে নাইম গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার স্কুল ছুটি হলে প্রতিদিন আমি তাকে তার ভাইয়ের সাথে বাসায় নিয়ে যাই। স্কুল কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করার পরও তারা আমার ছেলেকে ক্লাস করার কোনো সুযোগই দিচ্ছে না। নাইমের যমজ ভাই ক্লাস করলেও স্কুল চলাকালীন সময়ে নাইম উর রহমান স্কুলের মূল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার চিত্র বাবা হিসেবে আমাকে খুব কষ্ট দেয়। শিক্ষার্থী নাইমের বাবা মো. আবদুর রহমান তার সন্তানকে স্কুলে ফিরিয়ে নিতে স্কুলের প্রিন্সিপাল, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিসহ ঘুরছেন বিভিন্ন দপ্তরে।
আব্দুর রহমান জানান, চলতি মাসের ২ অক্টোবর রেজিস্ট্রি ডাকে আমার ছেলের টিসি নেওয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেছে। স্কুল ছাত্রের বাবা আবদুর রহমান আরও বলেন, দি বাডস রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ নাঈম-উর-রহমান বাংলা মিডিয়ামে স্কুলের ভর্তি কমিটির কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে নার্সারি ওয়ানে ভর্তি হয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত অনলাইন এবং অফলাইন ক্লাস করে। জুনের শেষ দিকে ইংলিশ মিডিয়ামের ভর্তি কমিটি কৃষ্ণা সূত্রধর, সোনিয়া সিদ্দিক এবং প্রিন্সিপাল জাহাঙ্গীর আলমের উপস্থিতিতে আবার ইন্টারভিউ দিয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে নার্সারি ওয়ানে ভর্তি হয়। ভর্তির পর সুন্দরভাবেই ক্লাস করছিল আমার ছেলে। হটাৎ ১৬তম ক্লাস থেকে ডায়েরিতে বিভিন্ন ধরণের নেতিবাচক মন্তব্য লিখে দিচ্ছিলেন ক্লাস টিচার কৃষ্ণা সূত্রধর। যা দেখে অভিভাবক হিসেবে তারা খুব কষ্ট পেয়েছেন। পরবর্তীতে সেই ডায়েরিতে লিখা কমেন্টগুলা রি-রাইট করেন এবং বাজে কমেন্ট লিখা ডায়েরির একটা পেজ ছিড়ে ফেলেন। মোট ৩৫টা ক্লাস করার পর ৩৬তম ক্লাস (১৯ সেপ্টেম্বর) থেকে আমার ছেলেকে আর ক্লাস করতে দেওয়া হচ্ছে না।
নাইমের বাবা আব্দুর রহমান বলেন, স্কুল থেকে বলা হয়েছে আমার ছেলে নাইম পড়াশোনায় মনোযোগী নয়। তার দুষ্টামির কারণে অন্যদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়াও নাইমকে নিয়ে আরও নেতিবাচক কথা বলেন। আমি স্কুল কর্তৃপক্ষকে মৌখিক এবং লিখিতভাবে বলেছি আমার ছেলে পড়ালেখায় অন্যদের ব্যাঘাত ঘটায় বা ক্লাসে ডিস্টার্ব করে কোনো ভিডিও ফুটেজ বা কোনো প্রমাণ থাকলে দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো ধরণের প্রমান আমাকে দেখাতে পারেননি।
এ বিষয়ে গভর্নিং বডির সভাপতি তাহসিন আহমেদ চৌধুরীর সাথে কথা বলেন ছাত্রের অভিভাবক আব্দুর রহমান। সভাপতি তাকে জানান, উনি অনেক ব্যাস্ত, প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে।
আব্দুর রহমান বলেন, আমি আমার সন্তানকে ক্লাস করতে দেয়ার জন্য বহুবার প্রিন্সিপালকে রিকুয়েস্ট করি। আমার ছেলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে ফিরে যেতে পারে সেজন্য আমি গত ৫ মার্চ স্কুলে একটি লিখিত প্রেয়ার দেই এবং রিসিভ করে নিয়ে আসি। সেখানে উল্লেখ করেছি আমার ছেলেকে হয় ক্লাস করতে দেয়া হোক, না হয় কারন উল্লেখ করে টিসি দিয়ে দেয়া হোক। এখন পর্যন্ত সেই প্রেয়ারের রিপ্লাই দেননি এবং টিসিও দেননি প্রিন্সিপাল। আমার ছেলের শিক্ষাবর্ষ শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং শিক্ষাজীবন বিপন্ন দেখে পরবর্তীতে মে মাসের ৮ তারিখে প্রিন্সিপাল বরাবর উকিল নোটিশ পাঠাই এবং কপি দেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা সচিব, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার আরো বিভিন্ন দপ্তরে। আমার অভিযোগের কথা জানতে পেরে ২৫ সেপ্টেম্বর স্কুলের প্রিন্সিপাল জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠিয়ে নাইমের টিসি নেওয়ার কথা বলেন। ব্যাকডেটে স্বাক্ষর করে পত্র দেওয়া হয়েছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বুধবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দীলিপ কুমার বর্ধন মুঠোফোনে বলেন, ‘কিছুদিন আগে আবদুর রহমান নামে বাডস্ স্কুলের একজন অভিভাবকের লিখিত একটি অভিযোগ আমি পেয়েছি। ব্যস্ত থাকার কারণে আমি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আসন্ন দুর্গাপূজার পর আমি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন মুঠোফোনে বলেন, বাডস্ স্কুলের একজন অভিভাবক আমার কাছে একটি লিখিত আবেদনপত্র নিয়ে এসেছিলেন। আমি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে বলে দিয়েছি বিষয়টি তদন্ত করতে। এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমার কাছে আসেনি। অভিভাবকের সাথে যদি ম্যানেজমেন্টের কোনো প্রবলেম থাকে আমাকে জানালে আমি কথা বলে সমাধান করে দেবো। আর ওই স্কুলে যদি পড়াতে সমস্যা হয়, অভিভাবক চাইলে আমি এ শিক্ষার্থীকে অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেবো।
প্রসঙ্গত, দি বাডস রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মূলত টি কমিউনিটির স্কুল। ১৯৭৮সালে ফিনলে টি কোম্পানি এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। টি কমিউনিটির স্কুল হলেও এখানে সবারই পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে এবং এই স্কুলের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বেও ফিনলে টি কোম্পানি রয়েছে। এই ফিনলে টি কোম্পানিতে নাঈম-উর-রহমান এর মা ডা. নাদিরা খানম ইনচার্জ হিসেবে বালিশিরা মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে কর্মরত রয়েছেন।
সর্বশেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০৩:০১
পাঠকের মন্তব্য