বনমানুষের গুহায়…


গেল ছুটিতে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম কোন দিকটায় যাব। পাহাড়সমুদ্র নাকি হাওড়।ছুটলাম হাজারিখিল অভয়ারণ্যের গহিনে থাকা বনমানুষের গুহা দেখতে। সঙ্গীরা তখনো কেউ জানে না কোথায় যাচ্ছি।আমি আর চালক শুধু দুজনই জানিমাইক্রো যাচ্ছে ফটিকছড়ি। নানা গল্পে সবাই মেতে রয়েছে।কিন্তু কেউ তেমন সাহস পাচ্ছে না জিজ্ঞাসা করতে। আসলে যাচ্ছিটা কোথায়।

 রাত প্রায় সাড়ে ৩টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে।

আমার ফোন পেয়ে হাজারিখিল ইকো ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিষ দাদার কানখাড়া। এত রাতে কেমনে এলেন দাদা।আরে দাদা দে-ছুট বলে কথা। শেষ রাতে তাঁবু টানানোর সুযোগ নেই। তাই আমাদের ঠাঁই হলো অফিস কক্ষে।যে যার মতো বেডিং বিছিয়ে চিত্পটাং। চোখটা লাগতে না লাগতেই ভিন্ন রকম স্বরের অনবরত মোরগের ডাক। ঘুম ঘুম চিত্তে ভাবলামহবে হয়তো কোনো পাহাড়ি মোরগের ডাক। কিন্তু নাহএকটা সময় ভালো লাগার পরিবর্তে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লাম। দেখলাম কমবেশি সবাই বিরক্ত।বড় গলায় পরিচয় দেয়া চৌধুরী বংশের রাকিবও বিরক্ত। কিন্তু কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।সবাই যখন বিরক্ত হয়ে ডাকের উৎস খোঁজায় ব্যস্ততখন সারা দিন ভালো-মন্দ মানুষের ভিড়ে থাকা মেহেদি উকিল আবিষ্কার করলআওয়াজটা রাকিবের ব্যাগ থেকে আসছেঅথচ সে- জানে না। তখন ওর সঙ্গে হাসব নাকি রাগ করব বুঝে ওঠার আগেই বললতার মেয়ে বাবার টাইমমতো ঘুম ভাঙানোর জন্য  অর্গানিক অ্যালার্মটা দিয়েছে।ওর কথায় সবার রাগের পারদ নিচে নেমে হাসির ঢেউ খেলাল। আবারো ঘুমানোর চেষ্টা। কিন্তু ঘুম আসার আগেই গাইড মান্নানের হাঁকডাক। তড়িত্গতিতে ফ্রেশ হয়ে ছুটলাম নাশতা খেতে। ভরপুর নাশতা করল সবাই। করণ সারা দিন আর তেমন দানাপানি পড়বে না পেটে।


সকাল প্রায় সাড়ে ৯টা। ছুটলাম এবার মূল অভিযান বনমানুষের গুহার পথে। নয়ন জুড়ানো চা বাগানঘেরা মেঠো পথে হেঁটে চলছি।হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় চা বাগান পেছনে ফেলে ঢুকে গেলাম অবারিত বুনো সবুজের গালিচায় মোড়ানো ঝিরি পথে। হাঁটছি আর দেখছি।পুরোটাই বুনো পরিবেশ।  বনটি হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের আওতাধীন।এখানে রয়েছে ২৫০ প্রজাতির গাছ  ১৫০ প্রজাতির পাখি।বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত বিরল প্রজাতির বইলাম গাছও রয়েছে।


২০১০ সালে  হাজার ৯০৮ হেক্টর পাহাড়ি অঞ্চল ঘিরে সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়  অভয়ারণ্য .এখনকার পথটা যেন আসলেই বন মানুষের চলাচল উপযোগী। দুই পাশের পাহাড় সরু হয়ে এসেছে।কখনো কোমর আবার কখনো বুকসমান পানি কেটে এগিয়ে গেলাম। আরেকটু এগিয়ে যেতেই চোখে ধরা দিল অজস্র পাথরের বোল্ডার।খুবই পিচ্ছিল পাথুরে পথ। একটা সময় পৌঁছে যাই সেই কাঙ্ক্ষিত বনমানুষের গুহায়। পুরোপুরি গা ছমছম করা বন্য পরিবেশ।রয়েছে নানা আকৃতির পাথরের ছড়াছড়ি। পাহাড়ের গায়ে ছোট-বড় গর্ত। রিমঝিম ছন্দ তোলা ঝরনা।দুই পাশের পাহাড় চেপে আসায় মধ্য দুপুরেও ভর সন্ধ্যা পরিবেশ। সব মিলিয়ে অসাধারণ মুহূর্তভালো লাগার মতো জায়গা বন মানুষের গুহা। কেনকী কারণে এর নাম  রকম হয়েছেতা  জনমানবশূন্য স্থানে কারো কাছে জিজ্ঞাসা করে জানার সুযোগ ছিল না। তবে জায়গাটা বনমানুষের গুহা নামকরণের যথেষ্ট সার্থকতা রয়েছে।

undefined


চলে যাই এবার ভাণ্ডারিয়া ঝরনায়। জানতাম তেমন পানি পাব না। তবু এগোলাম মায়াবী বুনোপথের জংলি ফুলের সুবাস নিতে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই ভাণ্ডারিয়ার প্রান্তে। বেলা প্রায় ৩টা।সবার পেটেই কমবেশি চো-চো। তাই চটজলদি সঙ্গে নেয়া নুডলস রান্নার জন্য গরম পানি বসিয়ে দেয়া হলো।  ফাঁকে ঝরনার জলাশয়ে নিজেদের পুকুর ভেবে জলকেলিতে মেতে উঠলাম মহানন্দে। গোসল শেষে নুডলস চেটেপুটে খেয়েদেয়ে ছুটলাম পাহাড়চূড়া বেয়ে নতুন এক ট্রেকিং রুটের সন্ধানে। গাইডের ভাষায় গাড়ির রাস্তা। কিন্তু আমরা দেখলাম চরম এক জংলি পথ। পথ বললে ভুল হবে। হরেক কিসিমের জোঁকের রাজত্ব। অল্প সময়ের ব্যবধানেই কমবেশি সবার দেহ রক্তে লালে লাল। ছোট্ট বেলার সেই ডায়ালগটা মনে পড়ে গেললালে লাল শাহজালাল। তবুও দেহের দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। একটা জোঁক ছাড়াতে গেলে আরো কয়েকটা জড়িয়ে ধরে। দেহে জোঁকের তেলেসমাতি নিয়েই রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত ট্রেকিং করে ফিরতে হলো বাংলোয়। বহু কষ্ট করে স্কচটেপ লাগিয়েরক্ত থামিয়েই শুরু হলো বার-বি-কিউ। দে-ছুট ভ্রমণ সংঘর ভ্রমণে বার-বি-কিউ না হলে যেন চলেই না। আজ থাক  পর্যন্তই। আগামী কোনো সংখ্যার জন্য তুলে রাখলাম পরদিন সকালে অংশ নেয়া অ্যাডভেঞ্চারটির গল্প।

যাবেন কীভাবে

ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস যায় চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি।সেখান থেকে সিএনজিতে হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। যাতায়াতে সবচেয়ে সুবিধা হবে নিজস্ব বা রেন্ট--কার বাহনে।দলে অন্তত সাতজন সদস্য  নিজস্ব তাঁবুতে ক্যাম্পিং করা হলে খরচ কম হবে।যারা সারা দিনের জন্য বনের ভেতরে যাবেনতারা প্রতি বেলা মাথাপিছু ১৩০ টাকা দিয়েও খেতে পারবেন।সঙ্গে শুকনো খাবারপানি  প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখবেন। বনের গভীরে ট্রেইল/ট্রেকিংয়ের সময় অবশ্যই দলবদ্ধ থাকতে হবে।

 

সর্বশেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৪:৪৭
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও