পাহাড়ি ছড়া, চা বাগান ও পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজার। এ জেলা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। জেলার ৭টি উপজেলায় দৈর্ঘ্যতম বহু বালুছড়া রয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসন বালুমহাল ইজারা দিয়ে অতীতে কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে।কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন জটিলতা ও সময়মত এসব বালুমহাল ইজারা না দেয়ায় স্থানীয় বালুখেকোরা প্রভাব খাটিয়ে দিন-দুপুরে অবৈধপথে সিলিকা বালুসহ অন্যান্য বালু উত্তোলন করে আসছে।
জেলা প্রশাসনের এক সূত্র থেকে জানা গেছে, জেলাজুড়ে এ পর্যন্ত ১৯টি এলাকার বালুমহাল টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৫০টি সিলিকা বালু ও সাধারণ আরও ২১টি বালুমহাল এখনো টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যায়নি। এ কারণে প্রায় ১ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এদিকে, বালুখেকোদের প্রভাবে এসব এলাকার সাধারণ নাগরিক মুখ খুলে প্রতিবাদ করার সাহস পাননা। স্থানীয়দের কারো মৌখিক অভিযোগে ইউএনও ও এসিল্যান্ড বালু মহালে অভিযান চালাতে গেলে বালুখেকোরা আগেই খবর পেয়ে যায়। তখন সরেজমিনে গিয়ে প্রশাসন তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় অনেকে জানান, ‘এসব বালুখেকোদের সাথে প্রশাসনের কারও না কারও যোগসাজশ তো রয়েছেই। নইলে তারা দিন-দুপুরে বালু উত্তোলন করার সাহস পায় কি করে।’
জেলার রাজনগর উপজেলার কুশিয়ারা নদীর জাহিদপুর, আব্দুল্লাহপুর এলাকার নির্জন স্থান থেকে স্থানীয় এ সকল বালুখেকোরা দিন-রাত অবৈধপথে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে ভাটি এলাকাসহ সিলেটের বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ এলাকায় বিক্রি বিক্রি করে। মাঝে মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন সরেজমিনে এসে হাতে-নাতে ধরে যৎ সামান্য জরিমানা করতো। কিন্তু বালু উত্তোলনের পেছনের শক্তি রাঘব-বোয়ালরা অধরাই রয়ে যায়।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কুশিয়ারা নদীর সুমারাই ও মৌলভীবাজার শহর ঘেঁষা সদর উপজেলার মনু নদের দুর্লভপুর, নদের কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর, সিন্ধুরখান ছড়া ও জেলার রাজনগর উপজেলার মারুয়াছড়া, ধামাইছড়া, কালামুয়াছড়াসহ নিলামে না যাওয়া আরও প্রায় ৭১টি বালুমহাল ও নদ-নদী থেকে দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন হয়ে আসছে। এখানকার স্থানীয়রা বলেছেন, সিলিকা বালু মহাল থেকে প্রতিদিন অবৈধপথে প্রায় ৯ লাখ টাকার, সাধারণ বালুমহাল থেকে ২ লাখ ১০ হাজার, কুশিয়ারা নদী থেকে ৫০ হাজার টাকা ও মনূ নদ থেকে প্রতিদিন আরো প্রায় ৭০ হাজার টাকার বালু বিক্রি করা হয়। এই হিসেবে সবগুলো বালুমহাল থেকে প্রতি মাসে ৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বালু বিক্রির লেনদেন করা হয়।
সরেজমিনে রাজনগর উপজেলার মারুয়াছড়া, কালামুয়া ও ধামাইছড়ায় গেলে দেখা যায়, দিনদুপুরে ছড়া থেকে যত্রতত্র বালু উত্তোলনসহ ট্রাকে বোঝাই করে সিলিকা বালু চড়া দরে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয় ও পরিবেশবিদরা বলেছেন, যত্রতত্র বালু উত্তোলন করায় নদী ভাঙ্গন ও চা বাগানের চলাচলের জায়গা ভেঙ্গে যাওয়াসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজনগর উপজেলার মারুয়াছড়া এলাকার পানিশাইল গ্রামের দুই ব্যক্তি বলেন, বালু সিন্ডিকেট চক্রের ৭/৮ ব্যক্তি দেদারছে ওই ছড়া থেকে দিন-রাতে বালু উত্তোলন করে আসছে। তারা উপর মহলে সাপ্তাহিক ও মাসিক মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে বালু বিক্রি করে। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় কেউ কথা বলার সাহস পান না। তারা বলেন, এক ট্রাক বোঝাই বালু ৩ হাজার টাকা ও ১ নৌকা বোঝাই বালু ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এভাবে তারা ওই ছড়া থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বালু বিক্রি করে থাকে। গ্রামের ওই দুই যুবক আরো জানান, বর্ষা মৌসুমে ছড়া থেকে নৌকা বোঝাই করে পাশের কুশিয়ারা নদীর কালারবাজারের ওপারের ডেকাপুর এলাকায় স্তুপ করে বালু রাখা হয়।
মৌলভীবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মোঃ মাঈদুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এসব এলাকায় অভিযান চালিয়েছি। বালু সিন্ডিকেট চক্র রাতের আধারে তাদের কার্য সম্পন্ন করে। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। রাজনগরের ইউএনও ফারজানা আক্তার মিতা বলেন, মারুয়াছড়া, কালামুয়া ও ধামাইছড়ায় অবৈধপথে বালু উত্তোলন হচ্ছে এমন তথ্য পাইনি। পেলে আমরা অভিযান চালিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো।
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আব্দুল হক বহু জায়গায় বালুমহাল ইজারা হয়নি এমনটা স্বীকার করে রোববার দুপুরে বলেন, বালুমহালগুলো ইজারা দিতে কোন সমস্যা নেই, পর্যায়ক্রমে ইজারায় যাচ্ছে। অবৈধপথে বালুমহাল থেকে উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, অবৈধভাবে কোথাও বালু উত্তোলন হলে আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালাচ্ছি।
সর্বশেষ আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৩, ০১:০৯
পাঠকের মন্তব্য