রুদ্র রুহান, বরগুনাঃ-
এই বুড়া বয়সে কোনোহানে যামুনা, বইন্যায় যদি মরন আয় তয় ঘরে বইয়াই মরুমু, ছেরেচ্ছাত (দূর্ভোগ পোহাতে) খাইতে কোনোহানে যামুনা’। নাতীকে বরগুনা শহরে পৌঁছ দিতে কর্দমাক্ত পথ ধরে হাঁটছিলেন বৃদ্ধা সেতারা বেগম। কথা হয় তাঁর সাথে, তিনি বলেন, ‘বাবা, ভাঙতে ভাঙতে এহন খালি পোতডু বাহি আছে, সবই তো বইন্যায় আর গাঙ্গে ভাইঙ্গ শ্যাষ, এহন বাহি আছে পড়ানডা যাওয়া, নাতিডারে ওর মা বাপের দারে পাডাইয়া ঘরে হুইয়া থাকমু, বইন্যায় যদি ভাইস্যা যাই তো যামু’ কোনোহানে আর যামুনা’। বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের মাঝখালী গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের বাইরে বসবাস করে। ওই এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, শনিবার বেলা চারটা নাগাদ কেউই নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নেননি। বিষখালীর কোল ঘেঁষে নদীসংলগ্ন একটি ঘর। সাড়া মেলে একজন প্রসূতি এই ঘরে এখনো রয়েছেন। কথা হয় তাঁর সাথে, আবদুর রহিমের স্ত্রী ফিরোজা বেগম বলেন, ‘জোয়ারের পানি বাড়লেই ঘর বাড়ি সব পানিতে তলাইয়া যায়, এহন আবার বইন্যা। কুম্মে যামু কি হরমু কইতে পারিনা কিছু, গেউদ্দার বাফে যদি কোথাও লইয়্যা যায় তয় যামু আনে’। তিনি বলেন, এখানকার বাসিন্দাদের কেউ এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেননি। যদি সবাই যায়, তবে তারাও তখন আশ্রয় নিতে যাবেন।
সুপার সাইক্লোন বুলবুলের প্রভাবে বরগুনায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা বরগুনায় শুক্রবার থেকে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। নদীতীরবর্তি বাঁধের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে ঝড়ের আতংক বিরাজ করলেও ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে চাইছেন না অনেকে। ফলে ঝুঁকির মধ্যেই থাকছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলরের এসব বাসিন্দারা। বরগুনার বিষখালী ও পায়রা নদী তীরবর্তি বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ও এর আশপাশে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। এদের অধিকাংশই পেশাজীবি জেলে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সতর্ক সংকেত জেনেছেন অনেকেই। তবে কেউ কেউ ভুল সংকেত আবার কেউ এখনো সংকেতের কথা জানেনই না। প্রত্যন্ত এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদী তীরের বাঁেধর কাছাকাছি ও বাইরের বাসিন্দাদের অনেকেই এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে যাননি। এমনকি কেউ কেউ যাবেননা বলেই ঠিক করেছেন। আশ্রয় কেন্দ্র দুরে ও পর্যপ্ত মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে বাড়িতে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছেন। অথচ এসব এলাকার বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে বসবাস করছেন।
বিষখালীর পশ্চিম পাড়ের কালমেঘা ও কুপদোন এলাকা। কালমেঘা বাজার থেকে এক কিলোমিটার এলাকায় নদী শাসন করে বøক দিয়ে স্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ দেয়া হয়েছে। তবে এর ঠিক দক্ষিণের অংশে দক্ষিণ কুপদোন এলকার প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা নদী ভাঙনে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁেধর এক তৃতীয়াংশ বিলীন। ওই এলাকার কয়েক হাজার পরিবার ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আতংকে রয়েছেন। নিজেদের জীবন বাঁচাতে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও ফসলী জমি. বাড়ি ঘর গাছ পালা ও গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতির আশংকায় রয়েছেন। ওই এলাকার ইউপি সদস্য শাহীন মিয়া বলেন, আমরা অনেক দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এখানে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কাছাকাছি আশ্রয় কেন্দ্র নেই। আমাদের বণ্য নিয়ন্ত্রন বাঁধটি স্থায়ীকরণ করা হলে এই দুশ্চিন্তা থাকতোনা।
সদর উপজেলার নলটোনা, রায়ভোগ, কুমিড়মারা, বালিয়াতলী, গোড়াপদ্মা, আয়লা-পাতাকাটা, গুলিশাখালীসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নদী তীরবর্তি এলাকার বাসিন্দারা চরম আতংকে রয়েছেন। নলটোনা এলাকার বাসিন্দা সেলিম শাহনেওয়াজ জানান, নলী সাজিপাড়া ও নলটোনা এলাকার অনÍত দুই কিলেমিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ঝূকিপূর্ণ। বিষখালীর ভাঙনে এসব বাঁধের প্রায় সম্পুর্ণ অংশ বিলীন। সামান্য যেটুকু টিকে আছে যে কোনো মুহুর্তে নদীগর্ভে চলে যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাঁধ না থাকলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, অনেকবার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এনেও কোনো সুফল পাইনি।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ঝুঁিকপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের দ্রæত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে আমরা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি। কেউ যাতে বাড়িতে অবস্থান না করে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমরা আশা কারি যথাসময়ে সবাই আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেবে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো তাদের জন্য পুরোপুরিভাবে প্রসাÍত রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ আপডেট: ৯ নভেম্বর ২০১৯, ২১:৫৪
পাঠকের মন্তব্য