মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ৮টা ৪০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেছেন বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালের সামনে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।
রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বিএসএমএমইউ হাসপাতাল ও এর আশপাশের এলাকায় সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করতে দেখা গেছে।
এদিকে উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে হাসপাতাল এলাকায় অন্যান্য রোগী ও তাদের স্বজনদের চলাচলে বেগ পেতে হচ্ছে। অনেকে হাসপাতাল থেকে বের হতে পারছেন না। অনেকে রোগী নিয়ে ঢুকতেও পারছেন না।
সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিট থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আবারও ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়। ৭টা ১০ মিনিটে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। পরে ৮টা ৪০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তার পিতার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে লিখেন- ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, কোরআনের পাখি ৮:৪০-এ দুনিয়ার সফর শেষ করেছেন’।
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বুকে ব্যথা নিয়ে গত রোববার সন্ধ্যায় বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি হন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদÐপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। কারাগার সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বুকে ব্যথাজনিত সমস্যার কারণে তাকে (দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী) গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। তার বুকে ব্যথা, হার্টে সমস্যা, প্রেশার ও ডায়াবেটিসজনিত কিছু সমস্যা ছিল। তাকে ইসিজিসহ যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এর সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ জানান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এ কারাগারে ছিলেন। ইতঃপূর্বে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর হার্টে পাঁচটি রিং পরানো হয়েছিল। এছাড়া তিনি দীর্ঘ দিন যাবত উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। এ ছাড়াও তিনি পায়ের গিরায় ব্যথাসহ বার্ধক্যজনিত নানান জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। অপরের সাহায্য ছাড়া তিনি একাকী হাঁটা-চলা ও উঠা-বসা কোনোটাই করতে পারছিলেন না। এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওসিয়ত অনুযায়ী খুলনা সদর উপজেলার বসুপাড়ার দারুল কোরআন সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসায় নির্ধারিত স্থানে তার লাশ দাফনের কথা রয়েছে। তার ইন্তেকালের খবর পেয়ে বৈঠক বসে মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি। বৈঠকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর লাশ মাদরাসায় আনা ও নির্দিষ্ট স্থানে দাফন করার বিষয়ে আলোচনা হয় বলে মাদরাসা সংলগ্ন জামে মসজিদের পেশ ইমাম আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও স্ত্রীর ওসিয়ত অনুযায়ী এ মাদরাসায় তার লাশ দাফনের জন্য জায়গা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা আছে। তাই তার মৃত্যুর খবর পেয়ে মাদরাসা কমিটির সদস্য ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ জরুরি বৈঠকে বসেন’। তিনি আরো বলেন, ‘সাঈদীর ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। খবর পেয়েই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। তিনি ঢাকায় আসার পর খুলনায় আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। আলোচনা ও সকল পর্যায়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে’।
দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রæয়ারি পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইউসুফ শিকদার গ্রামের খুব সাধারণ এক গৃহস্থ ছিলেন। ছোটবেলায় তিনি স্থানীয় লোকদের কাছে দেলোয়ার শিকদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তার প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন তার বাবার প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় একটি মাদরাসায়। তিনি ১৯৬২ সালে ছারছীনা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন ও পরবর্তীতে খুলনা আলিয়া মাদরাসায় স্থানান্তরিত হন। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের পর সাঈদী স্থানীয় গ্রামে ব্যবসা শুরু করেন। সাঈদী বাংলা, উর্দু, আরবি ও পাঞ্জাবি ভাষায় দক্ষ এবং ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায়ও তার দক্ষতা ছিল।
১৯৮০’র দশকের প্রথমদিকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দেশব্যাপী বিভিন্ন মাহফিলে ওয়াজ ও তাফসির শুরু করেন এবং তার সুন্দর বক্তব্য দানের ক্ষমতার জন্য দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন; এ সময়ই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী জোট গঠন করে এবং তিনি এ নির্বাচনে পুনরায় জাতীয় সংসদ-এর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুইটি অভিযোগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। পরে আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদন্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদÐের আদেশ দেন। তিনি সেই মামলায় সাজা ভোগ করছিলেন। এর আগে ২০১০ সালের ২৯ জুন রাজধানীর শাহীনবাগের বাসা থেকে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হন সাঈদী। পরে ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
সর্বশেষ আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০২:০৯
পাঠকের মন্তব্য