অন্তত এক ডজন ব্যবসায়ী-শিল্পপতির ওপর নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে! এ ‘নিষেধাজ্ঞা’ এসেছে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের কারণে। কোনো কোনো সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এমন তথ্য। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ক স্পষ্ট কোনো বক্তব্য মেলেনি। তাই নিশ্চিত হওয়া যায়নি কথিত এ ‘নিষেধাজ্ঞা’র সত্যতাও। বিষয়টির সত্যতা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও। তবে বিষয়টি এরই মধ্যে ‘টক অব দ্য নেশন’-এ পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত সচেতন মানুষদের মধ্যে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক কথা চালাচালি। ফলে এ তথ্য বড় এক অস্বস্তিতে ফেলেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের।
এরই মধ্যে দুর্নীতি দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছে- মর্মে স্বীকার করেছে বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের একটি টিম। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের কো-অর্ডিনেটর রিচার্ড নেফিউ নেতৃত্বাধীন টিমটি গত সোমবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে এমন সম্ভাব্যতার কথা জানান। ওই বৈঠকে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত রোববার রিচার্ড নেফিউ’র টিম দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)র সঙ্গে বৈঠক করেন।
বাংলাদেশের কয়েকজন নাগরিকের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে- বৈঠকে এমন কিছু আলাপ হয়েছে কি না- সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এভাবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি নিয়ে আলোচনা হয়নি। নেফিউ একসময় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করতেন। সেইক্ষেত্রে ‘নিষেধাজ্ঞাকে একটি হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহারের চিন্তাভাবনা তাদের রয়েছে। রিচার্ড নেফিউ যেভাবে বলেছেন তাতে নিষেধাজ্ঞা যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে- এমনটি ভাবছে তারা।
অর্থ পাচার নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তা কিছু বলেছেন কি-না এমন প্রশ্নে এ কে এ মাসুদ বিন মোমেন বলেন, টাকা পাচার দুর্নীতির একটি অংশ। টাকা পাচার নিয়ে আলাপ হয়েছে। কিছু ব্যাংক ছোট ছোট দ্বীপ-রাষ্ট্রে সহজে টাকা পাচার করে। এটি নিয়ে কথা হয়েছে। হুন্ডি নিয়ে কথা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা দরকার। যাতে কোনো ধরনের দায়মুক্তির সুযোগ না থাকে। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি বিচারের আওতায় না থাকলে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
এদিকে রিচার্ড নেফিউ’র ঢাকা সফরকালে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী-শিল্প পরিবার ‘এস. আলম গ্রæপ’-এর অর্থপাচারবিষয়ক একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠানটির অর্থ পাচারের বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। দুদকসহ তিনটি সংস্থাকে বলা হয়েছে তদন্ত শেষে আদালতকে অবহিত করতে।
এদিকে নির্ভরযোগ্য না হলেও বেশ কয়েকটি নিউজ পোর্টাল দেশের অন্তত এক ডজন ব্যবসায়ী-শিল্পপতির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে- মর্মে প্রতিবেদন প্রচার করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব প্রতিবেদনের লিঙ্ক শেয়ার হচ্ছে। চাউর হওয়া এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা এসব ব্যবসায়ী স্বনামধন্য এবং ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত। বলা হচ্ছে, এদের মার্কিন ভিসা বাতিল হবে। বাতিল হবে তাদের পরিবারের সদস্য, স্বজনদের ভিসাও। এদের বিরুদ্ধে অবৈধ পন্থায় অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী এদের নাম প্রকাশ করা হবে না। গত ৬ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ সফর করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের কো-অর্ডিনেটর রিচার্ড নেফিউ। তিন দিনের সফরে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব, পরারাষ্ট্র সচিব, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে সিরিজ বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে অর্থপাচারে কারা কী ধরনের ভ‚মিকা পালন করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান রিচার্ড নেফিউর টিম। অর্থপাচার রোধে সরকারের আইন এবং বিধি বিধানও পর্যালোচনা করেন মার্কিন কর্মকর্তারা। অর্থপাচারকারীদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কী সে সম্পর্কেও খোঁজ খবর নিয়েছেন তারা।
কোনো কোনো পোর্টাল এমন তথ্যও প্রকাশ করতে ছাড়েনি যে, দুর্নীতি দমনবিষয়ক মার্কিন প্রতিনিধি দল অন্তত ৩ ডজন সরকারঘনিষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পপতির তালিকা নিয়ে এসেছে। যাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড ও ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্রসহ অন্তত ১১টি রাষ্ট্রে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। অর্থপাচারকারী নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অবলম্বন করেছে কিছু মানডণ্ড। এর মধ্যে রয়েছে, (ক) বাংলাদেশ সরকারের বৈধ অনুমতি ছাড়া বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়। (খ) বৈধ চ্যানেল ছাড়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং তাতে অস্বাভাবিক লেনদেন। (গ) বিদেশে অবস্থানরত সন্তান বা স্ত্রীর নামে অস্বাভাবিক অর্থ বা সম্পদ ক্রয়। (ঘ) বিদেশে কোনো কোম্পানী প্রতিষ্ঠা বা কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় এবং (ঙ) অর্থের বিনিময়ে পাসপোর্ট কেনা সম্ভব-এমন দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ।
সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে- এমন কয়েকটি দেশও রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া নাম উল্লেখ করা হয়েছে অর্থপাচারের গন্তব্য হিসেবে।
পোর্টালগুলোর তথ্য অবশ্য অনেকেই আমলে নিচ্ছে না। তবে ঘটনা পরম্পরা মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত নিষেধাজ্ঞার ভিত্তি খুঁজছেন অনেক ব্যবসায়ী। কারণ গত ১৫ জুলাই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ব্যবসায়ী এবং সাবেক ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান- মর্মে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরাও সরকার ঘনিষ্ঠতা প্রমাণে তৎপর। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে একাধিক ব্যাংকের মালিক রীতিমতো দলীয় সেøাগান দেন। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ীদের ভ‚মিকা’ শীর্ষক এ সম্মেলনে বর্তমান সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। যা থেকে আলোচিত ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়ী নেতাদের ‘সরকার-ঘনিষ্টতা’র বিষয়টি দৃঢ়তা লাভ করে।
এসব হিসেব-নিকেশ থেকে এক ডজন ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়ী নেতার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার খবর অনেক ব্যবসায়ীর মধ্যে অস্বস্তি, অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। তবে সময়ই বলে দেবে- তথ্যগুলো সঠিক নাকি গুজব।
সর্বশেষ আপডেট: ৯ আগস্ট ২০২৩, ০১:১৩
পাঠকের মন্তব্য