বিএনপির এক দফা সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলনের গতি নিয়ন্ত্রণে কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির কর্মসূচির দিনে গতকাল সোমবারও রাজধানীসহ সারা দেশে শান্তি সমাবেশ নিয়ে মাঠেই ছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপির আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্যই দলীয়ভাবে কর্মসূচি দেবে আওয়ামী লীগ। তবে একে পাল্টা কর্মসূচি বলতে নারাজ দলটি। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তারা সঠিক কর্মসূচি নিয়েই মাঠে রয়েছেন। এক দিকে বিএনপির দেশবিরোধী আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র দাবি করে তা রুখে দিতে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। আগামীকাল থেকে এই কর্মসূচি শুরু হবে। জোটের এই সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচিতে সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনের মত বিভিন্ন কর্মসূচি থাকবে। যা দিয়ে মাঠ দখলে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। আওয়ামী লীগ ও জোট নেতারা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ১৪ দলীয় জোটের নেতাদেও মাঠে নামিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের সরকারের পক্ষে একটি জনমত তৈরী করতে চায় আওয়ামী লীগ ও জোটের হাইকমান্ড। বিএনপি নৈরাজ্য করছে এ বিষয়ে ২০১৪-১৫ সালের মতই জনমত তৈরী করতে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগের শরিকরাও।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রগুলো বলছেন, বিএনপির আন্দোলনকে গভীরভাবে নজরে নিয়ে কাজ করছে দলের একাধিক নেতা। বিএনপির কর্মসূচিতে মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগের কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এমনটাই করা হবে। তবে এটাকে কোন অবস্থায় বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি বলতে নারাজ দলটি। আওয়ামী লীগ নেতারা দলের এ কর্মসূচিকে দেশ রক্ষার জন্য কর্মসূচি অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, ভিসা নীতির কারণে কোন ধরনের নৈরাজ্য করার বিষয়ে বিএনপিও অনেক চাপে থাকবে। এ কারণে বিএনপির নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিতেই থাকবে। আর এক মধ্য দিয়ে জনমতও দলের পক্ষে রাখা সম্ভব হয়।
আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশকে পাড়ায় পাড়ায় ঠেকাবে বিএনপি। দলটির গতকালের সমাবেশে এমন বক্তব্য উঠে এসেছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপপতিমন্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপির তো অনেক কিছুই বলে। তবে আমরা মনে করি, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করা উচিত। আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা মনে করি, আমরা সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ সঠিক কর্মসূচি নিয়েই মাঠে রয়েছে। বিএনপি দেশকে সহিংতার দিকে নিয়ে যেতে চায় বলেই তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমরা অহিংসতায় বিশ্বাস করে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, বিগত দিনের মতো জ্বালাও-পোড়াও করে বিএনপি স্বরূপে ফিরেছে। বিএনপির আন্দোলন যত সহিংস হবে ততই আওয়ামী লীগের জন্য আন্দোলন মোকাবেলা করা সহজতর হবে। এতে বিএনপির আন্দোলন জনসমর্থন হারাবে, আর আওয়ামী লীগের ভুলত্রুটিকে কেন্দ্র করে বিগত দিনে বিএনপি যতটুকু জনসমর্থন পাচ্ছিল সেটাও ফিকে হতে থাকবে। সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে বিএনপির বিদেশি পরামর্শদাতাদের যে অবস্থান, সেখানে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে তাদেরই।
গত ২৭ জুলাই রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপিসহ সমমনা বিরোধীরা। একই দিনে রাজধানীতে শান্তি সমাবেশের ডাক দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৩টি সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। টানটান উত্তেজনার মধ্যে মহাসমাবেশ এক দিন পিছিয়ে দেয় বিএনপি। একই সঙ্গে নিজেদের কর্মসূচিও পেছায় আওয়ামী লীগের সহযোগীরাও। মহাসমাবেশ থেকে গত শনিবার রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। একই দিনে শান্তি সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে ডিএমপির অনুমতি না পাওয়ায় কর্মসূচি স্থগিত করে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে গত শনিবার জরুরী যৌথ সভা করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবি করেন বিএনপির এক দফা অগ্নি সন্ত্রাস। তিনি বলেন, আমরা যা আশঙ্কা করেছিলাম সেটাই এখন সত্যি হলো, আমরা বার বার বলেছি তাদের আন্দোলনের এক দফা অগ্নিসন্ত্রাস। তারা এটাই চেয়েছিলো। গতকাল তিনি বিএনপি জ্বালাও পোড়াও করেছে এ জন্য তাদের ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্যও করেন।
বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি সভা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই সভা থেকে রোববার রাজধানীসহ সারা দেশে ওয়ার্ড, থানায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শান্তি সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ। তবে পরে কেন্দ্রের নির্দেশে ওই কর্মসূচি পাল্টে থানায় থানায় শান্তি মিছিল ও সতর্ক অবস্থান করার কর্মসূচি দেয় দলটি।
গত শনিবার বিএনপির কর্মসূচিতে আহত হওয়া দলটির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ডিবি কার্যালয়ে খাওয়ার ছবি ও মহানগর আহ্বায়ক আমান উল্ল্যাহ আমানকে হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো উপহারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার পায়। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, এই ছবি দেখার পর আন্দোলনকারী কর্মীদের মনোভাবে চিড় ধরতে পারে। একই সঙ্গে নেতাদের প্রতি কর্মীদের আস্থার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আর তার নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে বিএনপির আন্দোলনের গতিতে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এক দিকে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি মেকাবেলা করে অপর দিকে জনমত দলের পক্ষে রাখতে কাজ করে যাবেন তারা। আগামী নির্বাচনের আগে এ কাজটি করে যেতে চান তারা। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির আন্দোলকে মোকাবেলায় নতুন নতুন কৌশন নিয়ে এগিয়ে যাবেন তারা।
এ দিকে আগামীকাল বিএনপির সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন মোকাবেলায় থেকে সপ্তাহব্যাপী সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালনের ঘোষনা দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগ নেত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সূত্রে জানিয়েছে, ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের শরিকরাও তাদের দলীয় শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে শুরু করেছে। গতকাল সোমবার ১৪ দলীয় শরিক দল জাসদও বিএনপির নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করে। দলীভাবে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে ওয়ার্কার্স পাটিও। ১৪ দলীয় জোট বিএনপির নৈরাজ্য, সন্ত্রান, জ্বালাও পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে ২০১৪-১৫ সালের মত জনমত গঠন করতে চায় বলেই জানিয়েছেন জোটের নেতারা। গতকাল সোমবার ওয়ার্কার্স পার্টির গাজীপুর জেলার বর্ধিত সভায় দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, নিবাচনকে ভন্ডুল করতে বিএনপি ২০১৪ সালের মতো সন্ত্রাস-সহিংসতার পথেই হাঁটছে। এ ক্ষেত্রে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেজিম চেঞ্জের কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। তবে অতীতের মতো এবারও তারা পরাভূত হবে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার রক্ষা করে যথাসময়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করবে।
সোমবার রাজধানীর ইস্কাটনে ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর বাসভবনে জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শেষে আগামী দিনে জোটের কর্মসূচি জানান আমু। তিনি বলেন, আগামী ২ আগস্ট থেকে আমরা (১৪ দল) মাঠে নামব। সাতদিনের কর্মসূচি আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সপ্তাহব্যাপী এ কর্মসূচি চলবে। তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি- বিএনপি সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছে। সাংবিধানিক ধারা ব্যাহত করে অন্যধারা প্রবর্তন করতে চায় তারা। তবে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে শর্ত দিক তা আমরা মানব। কিন্তু সাংবিধানিক ধারা ব্যাহত করে সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইলে সুযোগ দেব না।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনা নিে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ১৪ দল সমন্বয়ক আমু বলেন, যারা আলোচনায় বিশ্বাসই করে না। সরকার উৎখাতের কথা বলে। তাদের সঙ্গে কিসের সংলাপ? যারা রাজনৈতিক ধারা, সংবিধানের ধারায় বিশ্বাস করে না তাদের সঙ্গে কি কারণে বসব? সাংবিধানিক ধারা মোতাবেক দেশ যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেইভাবে পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি চলছে।
বৈঠকে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া, জাসদের শিরিন আখতার, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশার মাইজভান্ডারী, গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ওয়াজেদুল ইসলাম খানসহ জোটের শরিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ১৪ দলের আগামীকাল থেকে কর্মসূচি নিয়ে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশার মাইজভান্ডারী ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপির শরিকরাও তো রাজনীতির মাঠে নেমেছে, তাই আমাদেরও তো মাঠে নামা দরকার। আমরা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে অবশ্যই বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেব। আমরা অবশ্যই জনমত তৈরী করতে চাই। এ জন্য আমরা জোটগতভাবের বাইরে দলীয়ভাবেই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবো।
১৪ দলের ওই বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের পক্ষে রয়েছে চীন এ বিষয়টি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
সর্বশেষ আপডেট: ২ আগস্ট ২০২৩, ০১:১৯
পাঠকের মন্তব্য