সাত মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচার শেষ করে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। কাছাকাছি সময়ের চাঞ্চল্যকর আরেক ঘটনা বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যা মামলার বিচার এখনো শুরু হয়নি। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে প্রায় দুই মাস হতে চলল; কিন্তু এখনো অভিযোগ গঠনের জন্য মামলাটি সংশ্লিষ্ট আদালতে যায়নি। এখনো জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের জেনারেল রেজিস্ট্রার (জিআর) ফাইলেই রয়ে গেছে।
রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকার আইনজীবী মাহবুবুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক দুই আসামি হাজির না হওয়ায় মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি। নিয়মানুযায়ী পলাতক আসামিদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। এ অবস্থায় মামলাটি এখন জিআর ফাইলে রয়েছে।
বহুল আলোচিত এই মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ১ সেপ্টেম্বর ২৪ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর এক মাস ২৫ দিন পার হয়েছে। মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পলাতক আসামিদের হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার কাজটি দ্রুত করলে তা এত দিনে সম্পন্ন করা যেত।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ভুবন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক দুই আসামির বিষয়ে সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তাঁরা আদালতে হাজির না হলে তাঁদের অনুপস্থিতিতে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যাবে। সেখানে অভিযোগ গঠন হবে এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। পিপি জানান, এই মামলায় প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত (১৮ বছরের নিচে) দুই বয়সের আসামিই আছে। প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচারকার্য হবে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আর অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামির বিচার হবে শিশু আদালতে।
বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষন অত:পর
আজ থেকে ঠিক চার মাস আগে, ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রাস্তার ওপর রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রী আয়েশার সামনে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে একদল সন্ত্রাসী। হাসপাতালে নেওয়ার পর রিফাত মারা যান। তখন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে আয়েশার আপ্রাণ চেষ্টার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর সারা দেশে জানাজানি হয়, বরগুনা শহরে সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড নামের দুর্ধর্ষ এক সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে কিশোর ও তরুণদের নিয়ে গড়া বাহিনীর কথা। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কারও কারও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই বাহিনীর নানা অপকর্মের খবরও গণমাধ্যমে বের হতে থাকে। ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড।
বরগুনায় রিফাত হত্যার চার মাস পূর্ণ
অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে দুই মাস হতে চলল
এখনো অভিযোগ গঠনের জন্য মামলাটি আদালতে যায়নি
পুলিশ এই মামলার তদন্ত শেষে ২৪ জনের বিরুদ্ধে ১ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আসামিদের মধ্যে দুজন এখনো পলাতক, দুজন জামিনে এবং বাকি ২০ জন গ্রেপ্তার আছেন। এই ২০ জনের মধ্যে ১২ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাদের রাখা হয়েছে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। প্রাপ্তবয়স্ক ৮ আসামি আছেন বরগুনা কারাগারে। পলাতক ও জামিনে থাকাদের মধ্যেও দুজন কিশোর আছে।
তবে এ মামলার আরেক চাঞ্চল্যকর দিক হলো নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকার আসামি হওয়া। অভিযোগপত্র দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রধান ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। আয়েশার আইনজীবী মাহবুবু বারী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ গঠনকালে আয়েশাকে এই মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।
বিপর্যস্ত আয়েশা, নজরদারিতে পরিবার
প্রায় দেড় মাস কারাভোগের পর হাইকোর্টের আদেশে গত ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান কলেজছাত্রী আয়েশা। এরপর থেকে বরগুনা শহরে বাবার বাড়িতে আছেন।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, চোখের সামনে স্বামী খুন, তারপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নোংরা প্রচারণা, গ্রেপ্তার, কারাগার—সব মিলিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আয়েশা। সম্প্রতি ঢাকায় মনোরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা করানো হলেও আয়েশার অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। বাড়িতে চুপচাপ এবং একাকী থাকছেন। কারও সঙ্গে খুব একটা মিশছেন না। খাবারদাবারে মনোযোগ নেই। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আয়েশার ওপর যে ধকল গেছে তাতে তাঁর পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক দিন লাগতে পারে। এ জন্য তাঁকে মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
সম্প্রতি আয়েশার বাবা মোজাম্মেল হোসেন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আয়েশার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তাঁর বাবা মোজাম্মেল বলেন, ‘এখনো আমার মেয়ের বিরুদ্ধে ফেসবুকের মাধ্যমে কুৎসিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এতে আক্রমণ করা হচ্ছে পুরো পরিবারকে। এসব খবরে আয়েশা আরও বেশি বিষণ্ন হয়ে পড়ে। প্রায়ই একাকী কান্নাকাটি করে।’ তাঁর অভিযোগ, ‘এখনো আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর সব সময় নজরদারিতে করছে। আমরা কোথায় যাই, কী করি, কার সঙ্গে যোগাযোগ করি—সবকিছুই নজরদারি করছে।’ কারা নজরদারি করছে, এ প্রশ্নে তাঁর জবাব, ‘আপনারা বুঝে নেন।’
এর আগে বরগুনা-১ আসনের সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথকে বাঁচানোর জন্য আয়েশাকে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তাঁর বাবা মোজাম্মেল। গত রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই প্রভাবশালী মহলটি এখনো ভয়ে আছে, আসল ঘটনা উন্মোচন হলে ওরা ফেঁসে যাবে। এ জন্য তাঁরা আমাদের গতিবিধি অনুসরণ করে, ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমাদের সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টাকে ব্যাহত করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য।’ তাঁর দাবি, এই হত্যাকাণ্ড আয়েশাকে ঘিরে নয় বরং প্রভাবশালী মহলের বিশাল মাদকের ব্যবসার প্রভাব বিস্তার নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
উচ্চ আদালতে আয়েশাকে আইনি সহায়তা দেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগপত্রের অসংগতির বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। আমরা উচ্চ আদালতে যাব। যে বিষয়গুলোতে অসংগতি থাকবে সে বিষয়গুলো নিয়েই আমরা আইনি লড়াই করব।’ তিনি বলেন, এ মামলায় ৭৫ জন সাক্ষী রাখা হলেও সেখানে কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই। আয়েশা একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁকে আসামি করে এ মামলাকে হালকা করে দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৯, ২০:১০
পাঠকের মন্তব্য