প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁর অবসরের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশব্যাপী বিক্ষোভের কয়েক সপ্তাহ পরপ্যারিসের উপকণ্ঠে পুলিশের গুলিতে আলজেরীয় এবং মরোক্কান বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী তরুণ নাহেলের মৃত্যু দেশটিতে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে ম্যাখোঁকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
মঙ্গলবার গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় খুব কাছ থেকে পুলিশের গুলিতে নাহেল নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও দাঙ্গায় উত্তাল হয়ে ওঠে ফ্রান্স। বৃহস্পতিবার নেলসন স্কয়ারে নাহেলের মায়ের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষের যে শোক মিছিল বের হয়, সেখানে মিছিলকারীদের সাথে সংঘর্ষ ঘটে পুলিশের। মার্সেই, লিওঁ, পাউ, তুলুস, লিল ও প্যারিস সহ সমগ্র ফ্রান্সের বড় ও ছোট শহরগুলোতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। অনেক দালান ও পরিবহনে অগ্নিসংযোগ ও দোকানপাটে লুটপাট চালানো হয়েছে।
সবচেয়ে তীব্র ও সহিংস বিক্ষোভ চলছে নানতেরে এলাকায়। সেখানে বিক্ষোভকারীরা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, রাস্তা বন্ধ করে রাখে এবং পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানিন বৃহস্পতিবার রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৪০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করেন। তিনি টুইটারে জানিয়েছেন যে, পুলিশ এখন পর্যন্ত ৬শ’ ৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।ফ্রান্সের উপশহরগুলোতে যারা থাকেন, তারা নিজেদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং বৈষম্যের শিকার বলে মনে করেন।
নাহেলের মৃত্যুতে ফ্রান্সে পুলিশের ক্ষমতা এবং প্যারিসের উপশহরগুলোর মানুষের সঙ্গে এই বাহিনীর সম্পর্ক নিয়েও নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। যে পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে নাহেল মারা যান, তার বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছেকৃতভাবে খুনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ন’টার পর হতেই প্যারিস এবং বৃহত্তর অঞ্চলে সব বাস এবং ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। প্যারিসের অনেক উপশহরে কারফিউ জারি করা হয়। এই পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি করার কথা ভাবছে দেশটির নীতি নির্ধারকরা।
এদিকে, ফ্রান্সের বামপন্থীরা অভিযোগ এনেছেন যে, ফরাসি পুলিশকে ‘আমেরিকানাইজড’ বা মার্কিনীকরণ করা হয়েছে। দেশটির গ্রিন পার্টির নেতা মেরিন তোঁদেলিয়ার বলেছেন যে, তিনি এই সপ্তাহে যা দেখেছেন, তা হল ‘একজন পুলিশ কর্মকর্তার দ্বারা ১৭ বছর বয়সী একটি কিশোরকে উন্মুক্ত রাস্তায় হত্যা করা।’ তিনি বলেন, ‘আপনাদের সত্যিই ধারণা হয়েছে যে, আমাদের পুলিশকে মার্কিনীকরণ করা হচ্ছে।’ ফ্রান্সের পুলিশ সংগঠনগুলি, যারা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়াকে উপেক্ষা করার জন্য রাজনীতিবিদদের অভিযুক্ত করেছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তি দিয়ে আসছে যে, তাদের কাজ ক্রমবর্ধমানভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, কারণ সরকার গভীরভাবে গ্রোথিত সামাজিক সমস্যাগুলি সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার, তারা গুলি চালানো কর্মকর্তাকে আটকের জন্য বিশেষ ক্ষোভ প্রকাশ করে।জর্জ ফ্লয়েড, যিনি আফ্রিকান আমেরিকান ছিলেন, ২০২০ সালে মিনিয়াপোলিসে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে নিহত হন, যা কিছু অংশে পুলিশি হেফাজতে ফ্রান্সের বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর সাথে অনুভূত সমান্তরা ঘটনা হওয়ার কারণে দেশটি জুড়ে একটি কড়া ছাপ ফেলেছিল। বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের অন্যতম শীর্ষ সংবাদপত্র লে মন্দেঁর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘সুনির্দিষ্ট মার্কিন জাতিগত প্রসঙ্গ সম্পূর্ণভাবে বাদ দিলে, ঘটনাগুলি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই কাজটি একজন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল, চিত্রগ্রহণ এবং সম্প্রচার প্রায় সরাসরি করা হয়েছিল, এবং এতে সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার শ্রেণির একজন প্রতীকী প্রতিনিধি জড়িত ছিল: একজন শ্রমিক-শ্রেণি এলাকার একজন মানুষ।
’ম্যাখোঁ, যিনি নিজেকে ফরাসি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে পছন্দ করেন, এবং সুবিধা বঞ্চিতদের মতে ধনী শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, পরিস্থিতিটি তাকে একটি সূক্ষ¥ ভারসাম্যমূলক কাজ করতে বাধ্য করেছে। তিনি একদিকে হত্যাটিকে অমার্জনীয় এবং অবর্ণনীয় বলে অভিহিত করেছেনঅ অন্যদিকে তিনি এর সহিংস প্রতিবাদকে একেবারে অযৌক্তিক বলেও নিন্দা করেছেন। বিক্ষোভ বন্ধ করার জন্য তিনি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন, তা যদি খুব কঠোর হয়, তবে তা কেবল জনরোষ বাড়াতে থাকবে, যা মুসলিম বংশোদ্ভূত বা কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসীদের প্রতি অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরিচালিত পুলিশি সহিংসতা মনে করা হয়।সূত্র : দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
সর্বশেষ আপডেট: ১ জুলাই ২০২৩, ০২:২০
পাঠকের মন্তব্য