মুসলিম উম্মাহর ঐক্য জরুরি

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেক্স :

পবিত্র হজে খুতবায় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনাসহ ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসলামের রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে ভাই ভাই হয়ে তাওহিদের পথে অটল থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। আরাফার মসজিদে নামিরায় শায়খ ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ হজের খুতবায় বলেন, শয়তানের পথ পরিহার করতে হবে। কেননা শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। জীবনের সকল অঙ্গনে ইহসানের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দেওয়ার উজ্জ্বল দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় খুতবায়। সবাই এক আল্লাহর বান্দা। আরব-অনারব ভেদাভেদ নেই, কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, ধনী-গরীব পার্থক্য নেই। আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

লাখো হাজির ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল মুসলিমদের পূণ্যভূমি আরাফাতের ময়দান। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও মা হাওয়া আলাইহিস সালামের মিলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের মাধ্যমে গতকাল মঙ্গলবার ইসলামের ৫ম স্তম্ভ পবিত্র হজ আদায় করেছেন ২৫ লক্ষাধিক মুসলিম। এর মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের ১ লাখ ২২ হাজার ৮৩৩ জন। আরাফাত ময়দানে হজের প্রধান আনুষ্ঠানিকতায় সমবেত হয়েছেন সারা বিশ্বের ২৫ লাখের বেশি মুসলিম নরনারী। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেন সউদী আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শায়খ ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ।

মুসলিমদের জন্য করণীয় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয় হজের খুতবায়। এক আল্লাহর ইবাদত তথা নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত নিয়ে কোরআনের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়। আহ্বান জানানো হয় পরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষার। ইমাম বলেন, “আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর’। আল্লাহ তায়ালা নামাজ, রোজা এবং জাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, হজ তোমাদের ওপর ফরজ। মুসলিম উম্মাহর দুনিয়া ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও দিক-নির্দেশনা আসে এ খুতবা থেকে। ইমাম বলেন, আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আকড়ে ধরুন। আল্লাহ হুদুদ সংরক্ষণের অর্থ হলো- আমরা শুধু তারই ইবাদত করব। প্রত্যেক নবী (আ.) এই দাওয়াত-ই দিয়েছেন যে- এক আল্লাহর ইবাদত করো, নামাজ পড়ো, জাকাত দাও। জাকাত ও হজের হুকুম স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, মুসলমানের জন্য উত্তম চরিত্র অবলম্বন করা জরুরি। পবিত্র শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো- মুসলমান একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকুক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- শিরক করো না। মা-বাবার সাথে উত্তম আচরণ করো। গোনাহের কাজে সহযোগী হইয়ো না। তাকওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করো। শায়খ ইউসুফ বিন মোহাম্মদ বলেন, পবিত্র কোরআনে ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। ঐক্যের মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের সব বিষয়ের সাফল্য নিহিত। মুসলমানদের পরস্পর মিলেমিশে থাকা জরুরি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যে কোরআনের বিষয়ে অনৈক্য করবে, সে হেদায়াত থেকে দূরে সরে গেল। হজের খুতবায় তিনি আরো বলেন, আমাদের হুকুম দেয়া হয়েছে- নামাজ পড়ার, জাকাত আদায়ের ও দরিদ্রদের সহায়তা করার। পবিত্র হজও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। আপনারা আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করুন যেন তিনি আপনাদের দেখছেন। কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের, কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যেভাবে এই মাসটি সম্মানিত ও হারাম ঠিক তেমনিভাবে সবার জান-মালও হারাম। দিন-রাতের বিবর্তন আল্লাহর অন্যতম এক নিদর্শন।

মসজিদ হারামাইন শরীফাইন ফেসবুক পেইজে ও সউদীর টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় হজের যাবতীয় কার্যক্রম। মুসলিম উম্মাহ টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে হজের যাবতীয় কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। বিশ্বের ৩০ কোটির বেশি মানুষের কাছে ইসলামের শান্তিপূর্ণ বাণী পৌঁছে দিতে ২০টির বেশি ভাষায় খুতবা সম্প্রচার করা হয়েছে। এসব কাজের তত্ত্বাবধান করছে মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের জেনারেল প্রেসিডেন্সি বিভাগ।

এই ২০ ভাষার মধ্যে বাংলাও রয়েছে। এবার বাংলাভাষাভাষীদের জন্য হজের খুতবার বাংলা অনুবাদ করবেন ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান মাক্কী, মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব। তারা সবাই মক্কার বিখ্যাত উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। ২০২০ ও ২০২১ সালে হজের খুতবার বাংলা অনুবাদ করেছেন মাওলানা আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান মাক্কী। মূলত তার মাধ্যমেই খুতবার বাংলা অনুবাদ কার্যক্রম শুরু হয়।

সোমবার মধ্যরাতেই মিনা থেকে অনেকেই লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি দিতে দিতে একসঙ্গে মসজিদে নামিহরাতে উপস্থিত হয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন। মিনা থেকে বাস যোগে আরাফাত ময়দানে উপস্থিত হওয়া শুরু করেন হাজিরা। এ সময় যানবাহনের দীর্ঘ সারি পরিলক্ষিত হয়। দিনের আলো ফোটার পর যানবাহনের পাশাপাশি অনেকে পায়ে হেঁটেও আসতে থাকেন।

‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল-মুলক, লা শারীকা লাক’- অর্থাৎ উপস্থিত ‘হে আমার আল্লাহ, উপস্থিত। উপস্থিত, তোমার কোনো অংশীদার নেই, উপস্থিত। নিশ্চয় সকল প্রশংসা, নিয়ামত ও রাজত্ব তোমার, তোমার কোনো অংশীদার নেই’- এই তালবিয়াহ উচ্চারণ ও মহান আল্লাহ তা’আলার এককত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণার মাধ্যমে আরাফাতের ময়দানকে প্রকম্পিত করে সুষ্ঠু ও নিরাপদে হজ পালন করলেন বিশ্বের নানা দেশ থেকে আগত বৈশ্বিক করোনা-উত্তর দ্বিতীয় হজে সুযোগ পাওয়া ভাগ্যবানরা। আগের রাত থেকে মোয়াল্লেমদের তত্ত্বাবধানে আরাফাতের ময়দানে আগমন শুরু হলেও গতকাল সূর্যোদয়ের পরও অনেকে আসেন। মসজিদের নামিরা ও জাবালে রহমতকে ঘিরে থাকা ২

কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২ কিলোমিটার প্রস্থের আরাফাত ময়দানে হজযাত্রীদের পদভারে এক মনোরম দৃশ্যের অবতারণা হয়। এক আল্লাহর মহত্ব বর্ণনা ও তার নির্দেশ পালনের মাধ্যমে এদিন হাজী সাহেবরা তার কাছেই নিজেদের সমর্পণ করে দেন।

হজের খুতবার পর এক আজানে দুই ইকামতে যোহর ও আসর নামাজ কসর করে আদায় করা হয়। নামাজ আদায়ের পর হাজী সাহেবরা তাদের নিজ নিজ তাঁবুতে অবস্থান করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কায়মনোবাক্যে কান্নাকাটি করে মোনাজাত করেন। হজ পালনকারীরা আরাফাত ময়দানে তাসবিহ-তাহলিল-তাকবির ও ইসতেগফারের মাধ্যমে দিনটি অতিবাহিত করেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। জীবিত মৃত আতœীয় স্বজনের জন্যও রোনাজারি করে গুনাহ মাফ চান আল্লাহর দরবারে হাজীরা। সূর্যাস্তের পর হাজিরা বিভিন্ন যানবাহন যোগে এবং অনেকে পায় হেঁটে মুজদালিফায় অবস্থান নেন এবং সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ এক সাথে আদায় করেন। মুজদালিয়ায় খোলা আকাশের নিচে রাত্রী যাপন করেন হাজীরা।

প্রসঙ্গতঃ আরাফাতের ময়দানে হজযাত্রীদের খেদমতে সউদী আরবের প্রসিদ্ধ কোম্পানি ছাড়াও সরকারি এনজিও নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। সউদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মোবাইল কোম্পানিগুলো হাজীদের মাঝে বিতরণ করে ছাতা। বিভিন্ন কোম্পানি লাবাং, দুধ এবং মাল্টা, আপেল, ডালিমের জুস এবং পানি বিতরণ করে থাকে।

সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থানের পর হাজী সাহেবরা বাসে, ট্রেনে, ট্রাক বা পিক-আপে মুযদালিফায় রওনা দেন। ধনী-গরিব নির্বিশেষে হাজী সাহেবদের মসজিদে মাশআরিল হারাম কেন্দ্রিক মুযদালিফার খোলা প্রান্তরে পৌঁছে মাগরিব ও এশা আদায় করেন। তারা গতরাত সেখানেই কাটান। মুযদালিফা থেকে ৪৯টি কঙ্কর সংগ্রহ করেন হাজী সাহেবরা। এজন্য বিশেষ ধরনের ছোট ছোট পাথর ছড়িয়ে রাখা হয় পুরো মুযদালিফা জুড়ে। তবে অন্য যে কোনো স্থান থেকে হাজীরা এসব পাথর সংগ্রহ করতে পারেন।

আজ সূর্যোদয়ের পর আবার মিনায় ফিরে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পূর্বে বড় জামারাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ, কোরবানী সম্পন্ন করার পর মাথা মু-ন করে ইহরাম পরিত্যাগ করবেন হাজী সাহেবরা। সুযোগ বুঝে মক্কায় গিয়ে ফরজ তাওয়াফ করতে হবে ৩ দিনের মধ্যে। ১১ ও ১২ যিলহজও হাজী সাহেবদের সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর ৩টি জামারাতে ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। যারা সংক্ষেপ করতে চান ১২ যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করবেন। নইলে ১৩ যিলহজ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর আবারও ৩টি জামারাতে ৭টি করে ২১টি কঙ্কর মেরে মিনা ত্যাগ করতে হবে।

পরিশেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ের দিন বিদায়ী তাওয়াফের পূর্ব পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ ও যত বেশি সম্ভব তাওয়াফে সময় কাটাবেন হাজী সাহেবরা। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে সহীহ তরিকায় হজ পালন করে মাসুম বা গুনাহমুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন। আল্লাহর মেহমান হাজীদের যথাযথ সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে রাজকীয় সউদী সরকার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মক্কা ও মদিনায় ২৩টি হাসপাতাল ও ১৪৭টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেছে। এছাড়া মিনাতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে চারটি হাসপাতাল ও ২৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের জন্য প্রায় এক হাজার শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী।

এদিকে, সউদী আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইতিহাসে এবারই (২০২৩ সালে) সবচেয়ে বেশি হাজির পদচারণায় মুখরিত হবে কাবা প্রাঙ্গণ। রোববার বিশ্বের ১৬০টি দেশ থেকে আগত লাখ লাখ হাজিদের কাবা প্রদক্ষিণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় হজ। ইতিহাসের সবচেড়ে বড় হজ হওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এ বছর, আমরা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হজ প্রত্যক্ষ করব।’ ২০২০ সালের করোনা মহামারি হানা দেওয়ার পর এবার দ্বিতীয় বারের মতো সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার একসঙ্গে হজ করছেন ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত সৌদি দূতাবাস জানিয়েছিল, ২০১২ সালে হজ করেছিলেন ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৫৭৩ জন হাজি। যা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হজ ছিল। এবার এ সংখ্যাটি পার হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে হজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ১০ হাজার মানুষ; ২০২১ সালে ৫৯ হাজার। আর গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১০ লাখ। স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যায় হাজিরা মিনার তাবুতে অবস্থান নেন। যা কাবা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এরপর আরাফাত ময়দানে যান তারা। শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এই আরাফাতের ময়দানেই তার সর্বশেষ ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে উম্মতি মোহাম্মদীকে সত্যের ও কল্যাণের পথ দেখিয়েছিলেন।

সর্বশেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৩, ০২:০৩
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও