যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাই-প্রোফাইল সফরের মধ্যে, হোয়াইট হাউস ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে বলেছে, ‘আমরা এটি পরিষ্কার করেছি’।
বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরের প্রাক্কালে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফরেন প্রেস সেন্টারে আয়োজিত এক বিশেষ ব্রিফ্রিংয়ে মঙ্গলবার এ কথা বলেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনএসসি)’র স্ট্র্যাটিজিক কমিউনিকেশন পরিচালক অ্যাডমিরাল জন কিরবি। এসময় তিনি বাংলাদেশে মানবাধিকার ও নির্বাচন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে তার বক্তব্য লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে এক সাংবাদিক কিরবির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরে দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির মতো বিষয় কি আলোচনায় গুরুত্ব পাবে? পাশাপাশি তিনি কিরবির কাছে আরেকটি প্রশ্ন করেন যে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগের পাশে থাকবে কিনা? এর উত্তরে জন কিরবি বলেন, আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলবো- প্রেসিডেন্ট বাইডেন পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান এবং যে নেতার সঙ্গেই কথা বলেন না কেনো তিনি মানবাধিকার বিষয়ে তার উদ্বেগের কথা জানান দেন। এটি প্রেসিডেন্টের জন্য একটি স্বাভাবিক বিষয় এবং তিনি এ অবস্থানে অত্যন্ত দৃঢ়। মানবাধিকার এই প্রশাসনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সহযোগী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও এর ব্যতিক্রম হবেনা।
এরপর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত তাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করতেই পারে। কিন্তু আপনি সঠিক যে, বাংলাদেশে অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমরা আমাদের অবস্থান ইতোমধ্যে স্পষ্ট করে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অন্তরায় সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি ঘোষণা করেছি। আমরা কেবল আমাদের অবস্থান জানাতে পারি। আপনি জানেন আমাদের অবস্থানটা কোথায়। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট এবং প্রকাশ্য। তবে ভারত সরকার তাদের দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতেই পারে। বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের তৃতীয় রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। আগের দুইজন ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা ইউন সুক ইওল।
মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সমালোচিত হোয়াইট হাউস : মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের আয়োজন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদিকে, সমালোচকরা বলছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোদির ডানপন্থী সরকারের অধীনে ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখছে।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি সাংবাদিকদের বলেন যে মোদির মার্কিন সফর একটি ‘গভীর এবং ঘনিষ্ঠ’ অংশীদারিত্বের প্রতিশ্রুতি দেবে। তবে কিরবির মন্তব্যে অনেকাংশে অনুপস্থিত ছিল ভারতের মানবাধিকার রেকর্ড এবং মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদ নামে পরিচিত একটি অতি-ডান হিন্দু জাতীয়তাবাদী নীতি গ্রহণ সম্পর্কে উদ্বেগ, যা সমালোচকদের মতে দেশের সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
‘মিডনাইটস বর্ডারস: এ পিপলস হিস্ট্রি অফ মডার্ন ইন্ডিয়া’ এর লেখক সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, গত প্রায় এক দশক ধরে মানবাধিকার কর্মীরা নিয়মিত হোয়াইট হাউসকে জানিয়ে আসছেন যে, মোদির সরকার কর্তৃত্ববাদী, কট্টর ডানপন্থি, মুসলিম বিরোধী এবং সব সংখ্যালঘুদের বিরোধী। সমালোচকরা বলছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের তীব্র উত্থানের কারণে ভারতে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তার বিষয়ে মোদিকে চাপ দিতে হবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়কে মুছে দিয়ে দেশটিকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চায়। তাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অব্যাহতভাবে রাষ্ট্র-অনুমোদিত সহিংসতা এবং হয়রানির ঝুঁকিতে রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, এমন অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই এই হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পেছনে মোদির ভূমিকা উপেক্ষা করতে পারে না।
মোদিকে ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে হিন্দু চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দিয়েছিলেন। অথচ এই গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মুসলমানদের টার্গেট করার জন্য অভিযুক্ত। তবে এখন নিজের তৃতীয় হোয়াইট হাউস সফরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন মোদি। অথচ ভারতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে একযোগে সরব হয়েছে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। মোদির সফর নিয়ে ইতোমধ্যেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংগঠনের এশিয়া বিভাগের ডিরেক্টর এলেন পিয়ার্সন বাইডেনকে চিঠি দিয়েছেন। মোদির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তো বটেই, প্রকাশ্যেই ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
বাইডেনকে চিঠি ৭৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার : ওয়াশিংটন সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে তার দেশে মানবাধিকারের বিষয়গুলো উত্থাপন করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে অনুরোধ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ৭৫ জন সদস্য। মার্কিন কংগ্রেসের সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের এই আইনপ্রণেতারা সবাই ডেমোক্র্যাট দলীয় এবং বাইডেনের কাছে পাঠানো চিঠিতে তারা এই অনুরোধ জানান।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা বলেছেন, ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এবং সুশীল সমাজের গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়ে তারা উদ্বিগ্ন। সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন এবং প্রতিনিধি প্রমিলা জয়পালের নেতৃত্বে বাইডেনকে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা ভারতীয় কোনো নেতা বা রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না - এটি ভারতের জনগণের সিদ্ধান্ত - তবে আমরা সেই গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোর সমর্থনে দাঁড়িয়েছি যা আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতির মূল অংশ হওয়া উচিত।’ মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে পাঠানো ওই চিঠিতে মোট ৭৫ জন ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর এবং প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য স্বাক্ষর করেছেন। তবে মোদিকে বেশ ভাল রকমের সম্মানই দেখাতে যাচ্ছেন বাইডেন। তার জন্য আয়োজন করা হচ্ছে স্টেট ডিনারের। এর আগে শুধুমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ফ্রান্সের ফার্স্ট লেডির সম্মানে এ আয়োজন করেছিলেন বাইডেন। সূত্র : আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স।
সর্বশেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৩, ০০:৫০
পাঠকের মন্তব্য