ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’ রমজানের শেষে ‘খুশির ঈদ’ পূর্বেও এসেছে, সর্বদাই আসছে ভবিষ্যতেও আসতে থাকবে, এটাই ইসলামের চিরন্তন বিধান। কিন্তু ঈদের খুশি ক’জনেই বা উপভোগ করছে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার মত সময় কতজনের আছে, সেটাই প্রশ্ন। প্রতি বছরের ন্যায় খুশির ঈদের পুনরাগমন মুসলিম কওম ও মুসলিম মিল্লাতের পরম আনন্দের বিষয়। এই চিরাচরিত প্রথার অনুসরণ করতে আমরাও বাধ্য। রমজানের শেষে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় খুশির ঈদ খোশ আমদেদ।
আমাদের মধ্যে ক’জনইবা আছেন, যারা অনুসরণ করেন ইসলামের সেই শিক্ষার। কবির ভাষায়: ‘দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাতে দিল।’ ঈদের খুশি দুঃখী-দরিদ্র-বঞ্চিত-অসহায় সম্প্রদায় কখনো কি অনুভব করতে পারে? পারে না বলেই তো বিত্তবান ধনীদের প্রতি ধর্মীয় নির্দেশ ফিতরা-জাকাত ও অন্যান্য দান-খয়রাতের। রমজান মাসেই সিয়াম পালনে রোজাদারের কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে থাকলে তা সংশোধন করে নেয়ার জন্যই ফিতরা প্রথার প্রবর্তন হয়েছে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ জাকাত দানের বিধানটিও দেয়া হয়েছে প্রায় একই উদ্দেশ্যে। কিন্তু মুসলিম জাতি আজ জাকাত দান করাকে একটি অর্থনৈতিক বোঝা মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে ঈদ আদর্শের মধ্যে জাকাত প্রথা কেবল আত্মিক ও নৈতিক উন্নতিই সাধন করে না, গরিব-দুঃখীদের আর্থিক অভাব-অনটনও দূর করার জন্য এই প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
মাহে রমজানের শেষে ঈদের প্রস্তুতি পর্বগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। ১ শওয়াল তারিখের ফজরের সময় হতে সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা ধার্য করা হয়েছে। এটি প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, শিশু, ছোট-বড় আজাদ গোলাম, মুসাফির, রোজাদার, রোজা ভঙ্গকারী সকলের পক্ষেই আদায় করতে হয়। এমনকি কোনো শিশু এই সময় জন্মগ্রহণ করলে তার ফিতরাও আদায় করতে হয়। এই ফিতরা আদায় করার নিয়ম হচ্ছে, ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করা সুন্নত। দুই-একদিন আগেও আদায় করা যেতে পারে। কেউ যদি ঈদের নামাজের পর ফিতরা আদায় করে, তা সাধারণ সদকারূপে পরিগণিত হবে। তবে ওয়াজেব সদকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদায় করা না হলে পরে হলেও তা আদায় করতে হবে।
সদকাতুল ফিতর গরিব আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, ভিক্ষুক বিপদগ্রস্ত ইত্যাদি স্তরের লোককে দান করতে হয়। যেসব লোক যাকাত পাওয়ার উপযোগী ফিতরাও তাদেরই প্রাপ্য। পবিত্র কোরআনে এরূপ আট শ্রেণীর লোকের উল্লেখ আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার ওপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজেব, অথচ সে তা আদায় করে না, তার রোজাগুলি আসমান ও জমিনের মধ্যখানে ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে যায়। অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয় না। সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা প্রথা প্রবর্তনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর সকল মুসলমানের ঈদের আনন্দে সমভাবে শরীক হওয়া। ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য দূর করে সকলের একই কাতারে শামিল হওয়া। নারী-পুরুষ ছোট-বড় সকলকেই ঈদের আনন্দ উপভোগ করার সমান অধিকার দেয়া হয়েছে।
আর্থিক সঙ্গতির ব্যাপারেও জাকাতের ন্যায় কোন শর্ত আরোপ করা হয়নি, কেবল জাকাত প্রাপকরাই ফিতরা পাওয়ার উপযোগী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঈদের খুশি হতে যে কেউ বঞ্চিত হতে না পারে সেজন্য ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রকে অত্যন্ত প্রশস্ত ও ব্যাপকতর করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সদকা গ্রহীতাদের সংখ্যা করা হয়েছে অত্যন্ত সংকুচিত। সদকার তাৎপর্য এখানেই পরিলক্ষিত সমাজের কিছুসংখ্যক লোক, যারা সদকা প্রদান করতে সক্ষম নয়, তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। পক্ষান্তরে সদকা প্রদানকারীদের বহু স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে এবং তাদের সংখ্যাই বিপুল। অবশ্য এটা ভিন্ন কথা যে, বর্তমানে আমাদের সমাজে অক্ষম গরিব নামধারী এক শ্রেণীর সক্ষম বিত্তবান ব্যক্তিও গরিব-মিসকিনের বেশে, ভিক্ষুক সেজে প্রকৃত দুঃখী-গরিবদের ন্যায্য অধিকারে ভাগ বসাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিনা পরিশ্রমের এই পেশা ভালই চলছে। অবশ্য কে প্রকৃত দরিদ্র আর কে প্রকৃত দরিদ্র নয়, তা নির্ণয় করা কঠিন হলেও ছদ্মবেশী, কৃত্রিম লোকদেরকে চিহ্নিত করে প্রকৃত লোকদের মধ্যে তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব না হলে নকল ফকিরদের উৎপাত বন্ধ হবে না। পরিণামে যারা সদকা-জাকাত আদায় করে থাকেন, তাদের সেই সদকা জাকাতও উপযুক্ত পাত্রে না পৌঁছার আশংকা থেকে যাবে।
ঈদের একটি বিরাট ও সুদূরপ্রসারী আবেদন হচ্ছে, ভ্রাতৃত্ব বোধ ও ব্যাপক ঐক্য স্থাপন। সদকার মাধ্যমেও এই আবেদন অনেকটা পূরণ করা সম্ভব। তথাপি, আল্লাহর প্রতি সদকার মাধ্যমে এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে জামাত সহকারে ঈদের নামাজ আদায় করার মধ্যেও একই উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। জামাত সহকারে নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদের পরিবর্তে ঈদগাহ নির্ধারণ হতে ঈদের উদ্দেশ্য অনুধাবন করা যেতে পারে। ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়া মহানবী (সা.)-এর সুন্নত, তিনি সব সময় ঈদগাহে নামাজ আদায় করতেন। একবার ভীষণ বৃষ্টির সময় ময়দানে গমন করা সম্ভব ছিল না বলে হুজুর (সা.) মসজিদেই নামাজ আদায় করেছিলেন। এই একবার ব্যতীত তিনি আর কখনও মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি উভয় ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়তেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, বিপুল সংখ্যায় মুসলমানগণ যেন ঈদের নামাজের জন্য উপস্থিত হতে পারে। কেননা, মুসলিম ঐক্য ও সংহতি প্রকাশের জন্য এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু আজকাল দেখা যায়, মাঠে-ময়দানে তথা ঈদগাহের পরিবর্তে মসজিদগুলোতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে (বৃষ্টি-বাদল ছাড়াই) ঈদের নামাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
ঈদের গোটা উৎসবটাই হচ্ছে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আনন্দের সাথে ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ-সাম্য, মুসলিম ঐক্য-সংহতি এবং মানবতাবোধ তথা মানব কল্যাণের এক অপূর্ব নিদর্শন। সদকা, জাকাত, দান-খয়রাত, ঈদের সময় যাকাত প্রদান, খোতবা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করলে মুসলমানের ঈদোৎসবের সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়। ঈদের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে অন্যান্য জাতির আনন্দ উৎসবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলামের পূর্বে আরবে প্রচলিত আনন্দ-উৎসবের পরিবর্তে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ঈদ নির্ধারণের ঘটনাই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
ইতিহাস বলে, দুনিয়ার প্রত্যেক জাতির মধ্যে আনন্দ প্রকাশের বিভিন্ন উৎসব দিবস প্রাচীন যুগ থেকেই বিদ্যমান। তাদের ন্যায় মুসলমানদের জন্যও দুটি উৎসব দিবস ধার্য করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা হতে মদীনার হিজরত করলে সেখানে দেখতে পান যে, মদীনাবাসীরা দু›দিন আনন্দ-উৎসব পালন করছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের জন্য দুটি ঈদের দিন ধার্য করে দেন- একটি ঈদুল ফিতর এবং অপরটি ঈদুল আজহা। অন্যান্য জাতির উৎসব অপেক্ষা ইসলামের এই দুইটি দিন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অতি উত্তম। হিজরী দ্বিতীয় সালে রাসূলুল্লাহ (সা.) এ মহান ঈদের কথা ঘোষণা করেন।
ঈদের বৈশিষ্ট্য শাশ্বত, এর আদর্শ শিক্ষা চিরন্তন এবং এর আবেদনও অনাবিল, অন্যকোনো ধর্মে ঈদের এই তাৎপর্য, বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য পরিলক্ষিত হবে নাÑ ঈদের এই গৌরব কেবলমাত্র মুসলিম জাতির জন্য নির্ধারিত, মুসলমানগণই ঈদের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে এবং তারাই এর মৌলিক আদর্শ মূল্যায়ন করতে সক্ষম। এর শিক্ষা অনুসরণ করে নিজেদের জীবনকেও সার্থক এবং সাফল্যম-িত করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান বিশ্বে ঈদের যথার্থ আদর্শ কতটুকু গ্রহণ করা হচ্ছে? কেবল আনুষ্ঠানিকতা ও লৌকিকতা ব্যতীত মুসলিম উম্মাহ ঈদের আদর্শ হতে বহু দূরে সরে গেছে। আমাদের দেশেও দেখা যায়, আনুষ্ঠানিকতা প্রদর্শন ও অর্থব্যয়ের তীব্র প্রতিযোগিতা, যার সাথে ঈদের আদর্শের কোন মিল নেই। বরং ঈদের সাথে যোগ হয় ইসলামে নিষিদ্ধ অপচয় ও অন্যান্য শয়তানী কার্যকলাপের প্রতিযোগিতা। তাই সকলের উচিত, সত্যিকারের ঈদ-আদর্শের অনুসরণ করা এবং অপচয় ত্যাগ করা।
সর্বশেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:০৩
পাঠকের মন্তব্য