মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আলোচিত স্কুলছাত্র ফাহাদ রহমান মারজানের মৃত্যুর ২মাস পেরিয়ে গেলেও মৃত্যুর রহস্যের কোন কুল-কিনারা করতে পারেনি শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানা পুলিশ। ঘটনার পর থেকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়সারা, গাফলাতি ও খামখেয়ালীপনার অভিযোগ তুলে তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিহত ফাহাদের পরিবার।
পুলিশ ও রেলওয়ে স্টেশন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ৯ আপ সুরমা মেইল ট্রেনে কাটা পড়ে ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হলেও ওইদিন আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ট্রেনের চালকের দায়িত্বে থাকা মো. জাহিদুল ইসলাম তার পরিচালিত ট্রেনে কেউ কাটা পড়েছে বা ধাক্কা খেয়েছে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি বলে জানান।
এদিকে ফাহাদের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন কর্তব্যরত চিকিৎসক উল্লেখ করেছেন ‘Death was due to Head injury which was ante moriem’ | অর্থাৎ মাথায় আঘাত জনিত কারনে ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে। তবে কিসের আঘাত তা ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। তারপরও অপমৃত্যু মামলাতেই আটকে রয়েছে রেলওয়ে থানা পুলিশ।
নিহত ফাহাদের চাচা ইমাদ আলী জানিয়েছেন অধ্যাবদি পুলিশ দাবি করছে ট্রেন দূর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে ফাহাদের। নিহত ফাহাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তার পিতা মোহাম্মদ ফজলুর রহমান বাদি হয়ে রেলওয়ে থানায় হত্যা মামলার আবেদন করা হলেও তা রেকর্ডভূক্ত হয়নি। পরে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত, মৌলভীবাজারে দুইজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে আসামী করে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালত গত২৬ অক্টোবরের মধ্যে ঘটনার আদোপ্রান্ত আদালতকে জানানোর জন্য শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জকে নির্দেশ দিলেও এখনো কার্যত কোন অগ্রগতি নেই বলে দাবি করেছেন মামলার বাদি।
ফাহাদের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে দ্বারে-দ্বারে ঘুরছেন তার পরিবার। ফাহাদের মৃত্যুর পর থেকেই তার পরিবার অভিযোগ করে আসছে তাকে হত্যা করে রেল লাইনের পাশে ফেলে রেখে ট্রেন দুর্ঘটনা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে একটি চক্র। কিন্তু ঘটনার দিন থেকেই তাদের এ দাবি আমলে নিচ্ছে না পুলিশ।
জানা যায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার বাসিন্দা বিশিষ্ট সমাজসেবক ও মৌলভীবাজার জেলা দলিল লেখক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মোহাম্মদ ফজলুর রহমানের পুত্র ফাহাদ রহমান মারজান (১৭)’র নিথর দেহ গত ১২ অক্টোবর সকালে শহরতলীর শাহীবাগ এলাকাস্থ রেললাইনের পাশ থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মাথায় রক্তাক্ত কাটা আঘাত ছিল।
পরে রেলওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক মোল্লা সেলিমুজ্জামান হাসপাতালে গিয়ে মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। নিহতের সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে মাথার বাম পাশে ৬ বাই ২ ইঞ্চি একাধিক কাটা জখম, কপালে ৩ বাই ১ ইঞ্চি কাটা জখম, পিঠে ২ বাই ৩ ইঞ্চি ছেছড়া দাগ এবং বাম পায়ের হাটুঁর নিচে হালকা ও বৃদ্ধা আঙ্গুলে কাটা দাগ রয়েছে। দেহের বাকি সব অংশ স্বাভাবিক।
এদিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যখন ফাহাদের মরদেহ মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় তখন রেলওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোল্লা সেলিমুজ্জামান নিহত ফাহাদের পিতা আলহাজ্ব ফজলুর রহমানকে কম্পিউটারে প্রিন্টকৃত একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন। এ ব্যাপারে ফজলুর রহমান বলেন, ওই কাগজে লেখা ছিল ‘ফাহাদ আগের দিন থেকে নিখোঁজ রয়েছে’ এবং ‘ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে’। এসব দেখে আমি কাগজে স্বাক্ষর করিনি। ঘটনার পরপরই তদন্তের আগেই পুলিশ কিভাবে নিশ্চিত হলো আমার পুত্র ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।
এছাড়া আগের দিন থেকে নিখোঁজ রয়েছে মর্মে কাগজে উল্লেখ করা হলেও তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। ফাহাদ ঘটনার দিন ভোরে বাসা থেকে বের হয়। যা শহরের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরায় রয়েছে। ‘পুলিশ ওই গালগল্পে আমাকে স্বাক্ষর করার জন্য পীড়াপিড়ি করলেও আমি স্বাক্ষর করিনি’ বললেন নিহত ফাহাদের পিতা।
ফাহাদের পিতা ফজলুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে আমি নিশ্চিত আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই রেলওয়ে থানা পুলিশের ভূমিকা রহস্যময়। আমি চাই এ মামলার তদন্ত পিবিআই, র্যাব বা সিআইডির মতো কোন সংস্থার হাতে অর্পণ করা হোক। আমি তো ছেলেকে ফিরে পাবো না। আর যেন কোন বাবা-মায়ের সন্তান এভাবে পৃথিবী থেকে অনাকাঙ্খিতভাবে বিদায় না নেয়, সে জন্য পুরো ঘটনার রহস্য উন্মোচন হোক।’
এদিকে ঘটনার দিন সকাল অনুমানিক সাড়ে ৬ঘটিকায় শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে কি.মি. ২৮৭/৭ (যেখানে পড়ে ছিল ফাহাদের অর্ধমৃত দেহ) অতিক্রম করে ঢাকা থেকে সিলেটগামী ৯ আপ লোকাল সুরমা মেইল ট্রেন। ওই ট্রেনের চালক জাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জানান, শ্রীমঙ্গলে রেল স্টেশন প্রবেশমুখে ট্রেনের গতি স্বাভাবিকভাবে কমিয়ে আনা হয়। যেখানে ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে ট্রেনে কাটা পড়া বা ট্রেনের ধাক্কা এ ধরণের কোন ঘটনাই ঘটেনি।’
তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ট্রেনে চালকের দায়িত্ব পালন করি। ওই রুটে ট্রেনে কাটা বা ট্রেনে ধাক্কা লাগার কোন ঘটনা ঘটলে আমি অন্তত জানার কথা। কিন্তু সেদিন ওই রুটে কোন ঘটনা ঘটেনি তা আমি নিশ্চিত।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক মোল্লা সেলিমুজ্জামান বলেন, ঘটনার তদন্ত চলমান রয়েছে। সিডিআর পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিষয়টির তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ সাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, অধিক গুরত্ব সহকারে পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ করে প্রাপ্ত ফলাফল জানাতে পারবো। তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, ঘটনার দিন শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের কর্তব্যরত স্টেশন মাষ্টার মো. শাখাওয়াত হোসেনের লিখিত তথ্য পেয়ে রেলওয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায় বলে জানান শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্য।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বলেন, ‘মাথায় আঘাতের কারনে ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে।’
উল্লেখ্য, নিহত ফাহাদ রহমান মারজান চলতি বছরে শহরের শাহ মোস্তফা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সম্প্রতি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় এসএসসি উত্তীর্ণ হয়েছে ফাহাদ। এর কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড অনুমোদিত ই-জোন আইটি ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। এসব পরীক্ষার ফলাফল সে দেখে যেতে পারেনি।
সর্বশেষ আপডেট: ৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:২৭
পাঠকের মন্তব্য