সরকারি কর্মকর্তারা বরগুনায় বেশিদিন টিকতে পারেন না। বিশেষ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং এলজিইডিসহ ঠিকাদারিসংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে রয়েছে শম্ভু আতঙ্ক।
টেন্ডারবাজি ঠেকাতে ই-টেন্ডার চালু করা হলেও তা মানতে চান না শাসক দলের মদদপুষ্ট ঠিকাদাররা। এরা সবাই স্থানীয় এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুরই লোক। কথা না শোনায় প্রকাশ্যে একজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে মারধরের দৃষ্টান্তও আছে বরগুনায়। শুধু তাই নয়, কথিত দুর্নীতি মামলায় ফাঁসিয়ে তাকে জেলে পাঠানোর অভিযোগও আছে এমপির বিরুদ্ধে।
শম্ভুর হয়ে দফতরগুলোতে প্রভাব বিস্তারকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে আসা জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ, তেড়ে যাওয়া, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার উদাহরণও আছে একাধিক। তাই বরগুনায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই বদলির জন্য নামেন তদবিরে। বদলি হওয়ার পর তারা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন।
কামালভীতি সড়ক ও জনপথ বিভাগে (সওজ) : বাবা ছিলেন বরগুনা জিলা স্কুলের দফতরি। তারই ছেলে কামাল হোসেন এখন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। বাগিয়ে নিয়েছেন জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদও। সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদারও তিনি। বার্ষিক টার্নওভার হিসাবে বড় ঠিকাদার না হলেও বরগুনার সওজে তিনি ‘মুকুটবিহীন সম্রাট’। তার কথায় চলেন দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কথা না শুনলেই শুরু হয় গালাগাল ও লাঞ্ছনা।
বরগুনা জেলা স্কুলসংলগ্ন যে ভবনে কামাল ও তার পরিবারের বসবাস সেটিও সরকারি জমিতেই। তার আরেক ভাই মনিরুজ্জামান জামাল বরগুনা পৌরসভার কাউন্সিলর। ঠিকাদারি করেন গণপূর্ত বিভাগে।
সড়ক ও জনপথের বরগুনা জেলা অফিস সূত্র বলছে, এমপির ক্যাডার হিসেবে কামালকে কেউ কিছু বলার সাহসও পান না। যখনই নতুন নির্বাহী প্রকৌশলী দায়িত্বে আসেন তখন তাকে এমপি সাহেব ফোন করে কামালের কথা বলে দেন। বর্তমানে যিনি দায়িত্বে তিনিও এমপির ফোন পেয়েছেন ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেয়ার পরপরই। এর আগে এ পদে ছিলেন জাভেদ হোসেন তালুকদার। দাফতরিক নিয়মে কাজ করতে গিয়ে তাকেও শুনতে হয়েছে গালাগাল, মারতেও চাওয়া হয়েছিল। পরে তিনি নাটোরে বদলি হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচেন।
জানতে চাইলে প্রকৌশলী জাভেদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘৩ মাস ছিলাম বরগুনায়। পরে দেখলাম ওখানে মানসম্মান বাঁচিয়ে চাকরি করাই মুশকিল। তাই বদলি।’ জুনে বরগুনা ছেড়েছেন সওজের আরেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী অরুন কুমার বিশ্বাস। মে মাসে সওজের দফতরেই তার ওপর চড়াও হন কামাল। প্রায় ২ কোটি টাকার টেন্ডার বাগাতে ব্যর্থ হয়ে প্রকাশ্যে তাকে তেড়ে যান কামাল। ক্ষোভে-দুঃখে আর দফতরেই যাননি তিনি। জানতে চাইলে যুগান্তরকে অরুন কুমার বলেন, ‘বরগুনায় চাকরি করার মতো পরিবেশ ছিল না। আমি সিনিয়রদের জানানোর পর তারা আমাকে পটুয়াখালীতে বদলি করেন।’
এছাড়া এমপি শম্ভুর ক্যাডার কামালের গালাগাল শোনেননি এমন কর্মকর্তা এ দফতরে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এর মধ্যে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রাসেলও আছেন। সওজের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঠিকাদারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ই-টেন্ডার চালুসহ বার্ষিক টার্নওভারের ভিত্তিতে যোগ্যতা নির্ধারণ তার অন্যতম। কিন্তু তা মানতে চান না এ কামাল। কথা হল- তাকে কাজ দিতেই হবে। অন্য ঠিকাদাররাও কামালের হয়রানির শিকার। বরগুনার সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জাকির হোসেন অবশ্য মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
জুনে যে ৫টি আরএফকিউর (রিকোয়েস্ট অফ কোটেশন) কাজ হয়েছে তার ৪টিই পেয়েছেন (২৫ লাখ টাকা) কামাল। একই মাসে স্মল কোটেশনের ২০টি কাজের মধ্যে ১৫টিই পান কামাল। এটম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ১৭ লাখ টাকার সরবরাহও জুটেছে কামালের ভাগ্যে।
সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কাজ করছি। অনিয়মের সুযোগ নেই। যারা কাজ পেয়েছেন তার টেন্ডার দিয়েই পেয়েছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কামাল হোসেন বলেন, ‘এমপি মহোদয় আমাকে স্নেহ করেন। তাই বলে আমি কোনো অন্যায় করিনি। সওজ অফিসেও কোনো প্রভাব বিস্তার করিনি। আমি একজন ছোট ঠিকাদার। টুকটাক কাজকর্ম করে জীবনধারণ করি। যা বলা হচ্ছে তার পুরোটাই অপপ্রচার।’
কথা না শুনলেই চলে এমপি শম্ভুর হাত : বরগুনা সদরে পরপর ৫ বারের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। একবার ছিলেন উপমন্ত্রী। ২৭ বছর ধরে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে। দোর্দণ্ড প্রভাবশালী এ নেতার বিরুদ্ধে আমতলী উপজেলায় জমি কেনায় সরকারি রাজস্ব ফাঁকি এবং তালতলী উপজেলায় রাখাইনদের জমি কিনে টাকা পরিশোধ না করার বহু অভিযোগ রয়েছে।
বরগুনা থেকে বহু শ্রমিক কলকাতায় নিয়ে সেখানে বাড়ি তৈরির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতে দফতরে দফতরে লোক ফিট করে রাখার অভিযোগ আছে এমপি শম্ভুর বিরুদ্ধে।
সড়ক ও জনপথে কামালের মতো স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে আছেন তার আপন ভায়রা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিুকর রহমান। ২০১৬-১৭ সালে ই-টেন্ডার চালুর আগে এ সিদ্দিকুরই শম্ভুর হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন এলজিইডি। ঠিকাদার এবং দফতর সূত্রে জানা যায়, ই-টেন্ডারের আগে সিদ্দিকুরের কথা বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না কারও।
জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘আগে থেকেই ঠিকাদারি পেশার সঙ্গে জড়িত ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান। সফল ছিলেন না। এমপি শম্ভুর ভায়রা হওয়ার পর সফলতা আসতে থাকে।’
তার সিদ্ধান্তেই নির্ধারণ হতো শত শত কোটি টাকার কাজের ঠিকাদারি। ই-টেন্ডার চালুর পর তা কমে গেছে। এখন তার কাজ হচ্ছে, যারা কাজ পাচ্ছেন তাদের ওপর খবরদারি করা, কাজের অংশীদার করতে বাধ্য করা।
বরগুনা এলজিইডির এক প্রকৌশলী বলেন, ‘এমপির ভায়রা হিসেবে তার অনেক অন্যায় আবদার মেনে নিতে হচ্ছে।’ এ নিয়ে কথা বলার জন্যে সিদ্দিকুরের মোবাইলে কয়েকবার ফোন দেয়া হলে তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।
কয়েক বছর আগে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন আবদুল মালেক। আইলার পরে বরগুনায় যখন শত শত কোটি টাকার কাজ হয় তখন এমপির কথা অনুযায়ী কাজ না করায় মালেককে ডিসির দফতরের বারান্দায় নিজ হাতে চড়-থাপ্পড় মেরেছিলেন এমপি শম্ভু। তখন প্রকৌশলীরা আন্দোলনে নামার ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। বহু কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দিলেও ক্ষোভ ভুলতে পারেননি শম্ভু। তার কিছুদিনের মধ্যেই বরগুনায় দুর্নীতির এক মামলা হয় মালেকের বিরুদ্ধে। সেই মামলায় কিছুদিন জেলেও ছিলেন তিনি। পরে বদলি হয়ে বরগুনা ছাড়েন। কথা না শোনায় সওজের প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে।
আলাপকালে পাউবোর প্রকৌশলী আবদুল মালেক বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা সবাই জানেন। আলাদা করে কিছু বলার নেই।’
পিতার হয়ে সব অভিযোগ অস্বীকার পুত্রের : বর্তমানে ভারত সফরে আছেন এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। ফলে কথা বলা যায়নি তার সঙ্গে। বাবার হয়ে কথা বলেন এমপিপুত্র বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথ। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘আগাগোড়াই বলে এসেছি যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে এসব অপ-প্রচার চালাচ্ছে। বাবা ক্লিন ইমেজের রাজনীতিক বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পরপর ৬ বার দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। ৫ বার তিনি বিজয়ী হয়েছেন। দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসী হলে সাধারণ মানুষ তাকে বারবার ভোট দিয়ে এমপি বানাতেন না। আমার বাবা কোনোদিন ঠিকাদারি করেননি এবং সরকারি দফতরের স্বাভাবিক কার্যক্রমেও বিঘ্ন ঘটাননি। আমার খালু সিদ্দিকুর রহমান বিয়ের আগে থেকেই একজন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। বাবার প্রতিনিধি হিসেবে অন্য যাদের নাম বলা হচ্ছে, তারাও তো কেউ কোটি কোটি টাকার মালিক নন। বাবা ২২-২৩ বছর ধরে এমপি।
তার বাবার প্রতিনিধিত্ব পেলে তো তাদের শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার কথা। এসবই অপ-প্রচার। আমাদের হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা এটি। এসব অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবেই তিনি পরিচিত। এসব মিথ্যা অপ-প্রচার চালিয়ে তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা কখনোই সফল হবে না।
সুত্রঃ যুগান্তর
সর্বশেষ আপডেট: ৪ আগস্ট ২০১৯, ২১:০১
পাঠকের মন্তব্য