ভাগ্য ফেরাতে স্বামী সন্তান রেখে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিদেশ পাড়ি জমান শাহীনূর বেগম। ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে সরকারের লাইনেন্সধারী আল রাবেতা ইন্টারন্যাশনাল নামের রিক্রুটিং এজেন্সি তাকে লেবাননে গৃহকর্মীর কাজ দেয়ার কথা বলে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরে শাহীনূর জানলেন এটা লেবানন নয়, সিরিয়া। আর সেখানে গৃহকর্মী হিসেবে নয়, তাকে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে রাবাতা। সেখানে একটানা ৯ মাস পাঁচদিন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার সুযোগ মেলে তার।
পরিবারের চেষ্টায় র্যাবের সাহায্যে দেশে ফেরেন শাহীনূর। কিন্তু ততদিনে নির্যাতনে শরীর অক্ষম প্রায়। এখন শারীরিকভাবে অক্ষম স্বামী আর সাত বছরের এক সন্তান নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তার।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘সরকারি নিয়মে যেভাবে বিদেশে যেতে হয় সব প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করেছিল রাবাতা। এমনকি স্মার্টকার্ডও দিয়েছিল। কিন্তু আমাকে লেবাননে না পাঠিয়ে পাঠানো হলো সিরিয়ায়। আমি বৈধ কর্মী ছিলাম।’
শাহীনূর জানান, আল রাবাতার বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা করেছিল র্যাব। তারপরেই তাকে দেশে ফেরত আনা হয়।
শাহীনূর জানান, আল রাবাতার দালাল সিরাজ শিকদার তাকে পাচার করেছিলেন। মানবপাচার আইনে ধরা পড়লেও কিছুদিন পরে বেরিয়ে যায় আইনের জাল থেকে।
এদিকে এমন সব ঘটনায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা না নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ চিঠির একটি কপি জাগো নিউজের কাছে আছে। এতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা। যাতে বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে দেশ।
মানবপাচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, অন্যদিকে অভিবাসন আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের জেল।
তবে অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খোদ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এমন চিঠি প্রতারণার শিকার হওয়া অভিবাসীদের সুবিচার পাওয়াকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর এ ধরনের চিঠি তাই হতাশ করেছে তাদের।
প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী (বর্তমানে মন্ত্রী) ইমরান আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, মানবপাচার আইনের পরিবর্তে রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনে মামলা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ লেখেন, ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনের আওতায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানো হয়। কর্মী পাঠানোর জন্য সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ১ হাজার চারশ’র বেশি রিক্রুটিং এজেন্ট আছেন, যার অধিকাংশই বায়রার সদস্য।
চিঠিতে বলা হয়, রিক্রুটিং এজেন্টরা বিদেশে নিয়োগকর্তার কাছ থেকে চাহিদা ও এমপ্লয়মেন্ট ভিসা সংগ্রহ করে বাংলাদেশের মিশন থেকে যাচাইপূর্বক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে বিএমইটি জমা দেয়।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সব প্রক্রিয়া মেনে বিএমইটি বহির্গমন ছাড়পত্র এবং স্মার্টকার্ড দিয়ে কর্মীদের বিদেশ পাঠায়। বিদেশে কর্মক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে দূতাবাস, মন্ত্রণালয় ও বিএমইটির দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্টারাই ওই কর্মীদের সমস্যার সমাধান করেন।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জানান, যদি কোনো কারণে কর্মী বিদেশ থেকে ফেরত আসেন বা কর্মস্থলে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন তখন ভুক্তভোগী কর্মী থানাসহ বিভিন্ন সংস্থায় সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্টের বিরুদ্ধে সত্য হোক, মিথ্যা হোক বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিবাসী আইন অনুসরণ না করে কর্মীদের অভিযোগ মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের অধীনে মামলা করে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্টদের হয়রানি, গ্রেফতার করেন। ফলে এজেন্টরা প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
জনশক্তি পাঠানোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে স্মার্টকার্ড প্রাপ্ত কর্মীদের যেকোনো অভিযাগ মামলা করার পূর্বে প্রবাসী কল্যাণ, বিএমইটির মাধ্যমে সত্যতা যাচাই এবং এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্টদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা না করার জন্য সুপারিশ করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশে নিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করা বা তার সঙ্গে প্রতারণা করার প্রমাণ মিললে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা এজেন্সির বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা করা যাবে।’
ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শ্রম অভিবাসন করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হলে যদি বৈদেশিক কর্মসংস্থান আইনে ক্ষতিপূরণসহ অনেক কিছু করার সুযোগ আছে।’
‘তবে আজকাল অনেক ক্ষেত্রে প্রলোভন দেখিয়ে কর্মীদের পাচার করা হয়। বিদেশে কাজের নামে পাচার হলে তখন কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, প্রশ্নটা সেখানে,’ বলেন তিনি।
শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, হয়তো তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী তাদের প্রোটেকশনের জন্য এ চিঠি দিয়েছেন। যদি সৎ ব্যবসায়ী এ ধরনের ক্ষেত্রে মানবাপাচারের শিকার হয়ে থাকেন বা বিপদে পড়েন তাদের জন্য এ সুপারিশ হতেই পারে।’
‘তবে যে সব দুষ্টু ব্যবসায়ী প্রতারণা করে আসলে কর্মী পাচার করে, তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় একইভাবে মানবপাচার আইনে মামলা নেয়ার প্রস্তাব করে চিঠি দিতে পারে,’ মনে করেন ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান।
দেশে মানবপাচার আইনে ৪ হাজার ৬৬৮টি মামলা হয়েছে। কিন্তু নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৫টি মামলা।
সর্বশেষ আপডেট: ৩ আগস্ট ২০১৯, ২২:৪৪
পাঠকের মন্তব্য