তিন ই-কমার্স বন্ধ হলেও গ্রাহকদের দুই হাজার কোটি টাকার কি হবে

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

দেশের অনলাইন প্লাটফর্ম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত দশটির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ ও কয়েকজন গ্রেফতার নিয়ে তোলপাড় চলছে। এরমধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছেন। ইভ্যালি ও ই-ওরেঞ্জের মালিক-চেয়ারম্যান, এমডিসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

ধামাকা শপিং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করে টাকা ফেরত চেয়ে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। ই-ভ্যালির ৩১১ কোটি টাকা, ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১১০০ কোটি টাকা গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে। অনদিকে ধামাকা শপিং নামে আরেকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫৮৯ কোটি টাকা নিয়ে ‘লাপাত্তা’ হওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের কাছেই গ্রাহকদের ১ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারণা করে গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় নাম আসা বনানী থানার পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানাকে গ্রেফতার করেছে ভারতীয় পুলিশ। ৩ সেপ্টেম্বর তাকে ভারতের চ্যাংরাবান্দা সীমান্ত থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আটক করে। পরে স্থানীয় পুলিশের হাতে তাকে সোপর্দ করা হয়। ভারতের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে-পরিদর্শক সোহেল রানকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ই-অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

এদিকে অনিয়মের অভিযোগ ওঠা ইভ্যালিসহ ১০ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে কমিটির বৈঠক শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক ও ডিজিটাল ই-কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ই-কমার্সের নামে কেউ প্রতারণা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। এছাড়া, ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া ই-অরেঞ্জের সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, গ্রাহককে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই হবে ইভ্যালিকে। চটকদার বিজ্ঞাপন আর লোভনীয় অফার দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে ফাঁদে ফেলেছে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে সম্ভাবনার এই ডিজিটাল খাত নিয়ে মানুষের মনে তৈরি হয়েছে সন্দেহ অবিশ্বাস। যা এই খাতের টিকে থাকার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জের মতো এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ আছে। মন্ত্রী বলেন, গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করে পার পাবার সুযোগ নেই। তবে, গ্রাহকদের লোভনীয় অফারে না ভুলে জেনশুনে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে লেনদেন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ইভ্যালি গ্রাহককে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হলে আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। মানুষের অনেক টাকা নিয়েছে ইভ্যালি। কীভাবে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে তা আমার জানা নেই। আমরা মনে করি, তারা গ্রাহকদের যে কমিটমেন্ট দিয়েছে, তারা যদি সেটি পূরণ করতে না পারে, তা হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এটি করতেই হবে’। ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারে সাড়া দেয়ার আগে, সেটি বাস্তবসম্মত কিনা, সেটি যাচাই করে দেখতে গ্রাহক ও ক্রেতাদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন আসাদুজ্জামান।

গ্রাহকদের কাছে ইভ্যালির দেনা ৩১১ কোটি টাকা: কর্মকর্তারা গ্রেফতারের আগে ইভ্যালি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল, শুধু গ্রাহকদের কাছে তাদের দেনার পরিমাণ ৩১১ কোটি টাকা। আর এই দেনা আছে মোট  ২ লাখ ৭ হাজার ৭৪১ গ্রাহকের বিপরীতে। এ হিসাব গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত। তিন দফায় তথ্য দেয়ার দ্বিতীয় দফায় গ্রাহকদের কাছে দেনার পরিমাণ ও গ্রাহকসংখ্যা জানাতে পারেনি। এরই মধ্যে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতারের পর র‌্যাব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছে। এতে জানা যায়, দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে ‘কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণার’ পরিকল্পনাও করছিলেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব। বিপুল সংখ্যক গ্রাহক তৈরি করে ইভ্যালির ‘ব্র্যান্ডভ্যালু’ বাড়ানোর পরিকল্পনাও ছিল তার। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলন করে এসব কথা জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এদিকে  ইভ্যালির এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে প্রথম দফায় ৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার রাসেলকে ফের দ্বিতীয় দপায় রিমান্ডে নেয়া হয়। তার স্ত্রীকে পাঠানো হয় কারাগারে।

ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১,১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ: ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তাহেরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক গুলশান থানায় এমন অভিযোগ জানিয়ে মামলা করেন। মামলায় ই-অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, মালিক বীথি আকতার, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আমানউল্লাহ চৌধুরী, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা কাওসার আহমেদসহ প্রতিষ্ঠানটির সব মালিককে আসামি করা হয়েছে। ওই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে যান সোনিয়া মেহজাবিন ও মাসুকুর রহমান। কিন্তু আদালত তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

৫৮৯ কোটি টাকা নিয়ে ‘লাপাত্তা’ ধামাকা শপিং: অন্যদিকে গ্রাহকদের কয়েক শ’ কোটি টাকা নিয়ে ‘লাপাত্তা’ হলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিং। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও আকর্ষণীয় ছাড়ে পণ্য বিক্রির ফাঁদ তৈরি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ৫৮৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) জসিমউদ্দিন চিশতি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন বলে জানিয়েছে অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির অফিস বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের ফোন নম্বরও। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ধামাকায় অর্ডার পেমেন্ট করা হাজারো গ্রাহক। তবে শপিং প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও মাঝে মধ্যেই ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করে আসছেন কোম্পানির এমডি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই ধামাকা শপিং কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লেনদেন হতো। গত জুন মাস পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়। তখন পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে লেনদেনের পরিমাণ ৫৮৮ কোটি ৯১ লাখ ৫ হাজার ৮৫২ টাকা। তবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হলেও বর্তমানে অ্যাকাউন্টটিতে রয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার ৭৩১ টাকা। সম্প্রতি গ্রাহকরা টাকা ফেরত চেয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রতিষ্ঠানটির কর্নধারদের আল্টিমেটাম দিয়েছেন।

ই-কমার্স নিয়ে হাইকোর্টের পরামর্শ: ই-কমার্সের নামে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হওয়ায় গ্রাহকদের লোভ কমাতে জনস্বার্থে প্রচারণা চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে ই-কমার্সের নামে প্রতারণা রোধে মানুষকে সচেতন করার কথাও বলেছেন আদালত। রোববার ফোনে আড়িপাতা বন্ধ চেয়ে করা রিটের শুনানিতে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মুস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন পরামর্শ দেন। ফোনে আড়িপাতা বন্ধে রিটের শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনিরের কাছে ই-কমার্স বিষয়ে জানতে চান হাইকোর্ট। তখন শিশির মনির বলেন, আমাদের দেশে ই-কর্মাস ব্যবসার নামে অনেক বেশি ফ্রি অফার থাকে। যা বিদেশি প্রতিষ্ঠান আলিবাবা, অ্যামাজনে থাকে না। আমাদের দেশের গ্রাহকরা অতি লোভে পড়ে প্রতারণার শিকার হন।

এর প্রেক্ষিতে আদালত বলেন, ‘হ্যাঁ আমরাতো দেখি, একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি। বিমানের টিকিট কিনলে হোটেল ফ্রি। আপনারাতো পাবলিক ইন্টারেস্টের মামলা করেন। আপনাদের উচিত পাবলিকদের সচেতন করা, তারা যেন এক্ষেত্রে লোভ কমান।’ অন্যদিকে শিশির মনির আদালতকে বলেন, আমাদের দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিষয়টা এমন যে, প্রথমে তারা অফার দেবে- একটা মোটরসাইকেলের টাকায় দুইটা মোটরসাইকেল। এরপর গ্রাহকরা টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল পাবে এবং টাকাটা বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটওয়ে দিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে চলে যাবে। এরপর আবার দুইটা কিনলে আরও দুইটা ফ্রি, চারটা কিনলে আরও চারটা ফ্রি পাবে এমন অফার আসে। আইনজীবী শিশির আরও বলেন, কিন্তু এক পর্যায়ে যখন গ্রাহক অধিকসংখ্যক যেমন, আটটা মোটরসাইকেল কিনলে আরও আটটা মোটরসাইকেল পাওয়ার জন্য টাকা দেয় তখন সে টাকা চলে যায়, কিন্ত মোটরসাইকেল আর আসে না।

আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, আড়িপাতা ও ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় রিটের শুনানিতে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব কথা বলেন। তিনি জানান, দেশের মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বেশকিছু ই-কমার্স মার্কেট থেকে। তখন ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জ নিয়ে কথা উঠলে আদালত জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।

সর্বশেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৪৮
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও