গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে ‘কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণার’ পরিকল্পনা করছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব। বিপুল সংখ্যক গ্রাহক তৈরি করে ইভ্যালির ‘ব্র্যান্ডভ্যালু’ বাড়ানোর পরিকল্পনাও ছিল তার। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর গতকাল শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলন করে এসব কথা জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এদিকে ইভ্যালির এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, একটি বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফার (১ঃ২) এর আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে কোম্পানি শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপানোও ছিল পরিকল্পনার অংশ। এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনা নেন রাসেল। দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়ানোর আবেদনও একটি অপকৌশল মাত্র। সর্বশেষ তিনি দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা করেছিলেন।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকা; তাদের চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা, বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। নানা সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ দায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে রাসেল দম্পতি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানটির আরও দায়-দেনা রয়েছে জানিয়ে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, দায়ের সর্বমোট পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকার বেশি। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি কোম্পানি, কোনো ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করা হতো। ফলে দেনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার রাসেল আরও জানান, ইভ্যালি ছাড়াও তার আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম রয়েছে।
এর মধ্যে ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি দিয়েই ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল। তার ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়া। তিনি বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন, যাতে দ্রুততম সময়ে ক্রেতা বৃদ্ধি করা যায়। র্যাবের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ইভ্যালির গ্রাহক সংখ্যা ৪৪ লাখেরও বেশি। তিনি বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে এত সংখ্যক গ্রাহক সৃষ্টি করেছেন। ইভ্যালির বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলো হলো-সাইক্লোন অফার বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রি, ক্যাশব্যাক অফার (মূল্যের ৫০-১৫০% ক্যাশব্যাক অফার) আর্থকুয়েক অফার প্রায়োরিটি স্টোর, ক্যাশ অন ডেলিভারি। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও ছিল জমজমাট অফার; যেমন- বৈশাখী কিংবা ঈদ অফার ইত্যাদি।
বিক্রি বাড়ায় গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদাও বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, মোটরবাইক, গাড়ি, গৃহস্থালি, প্রসাধনী, প্যাকেজ ট্যুর, হোটেল বুকিং, জুয়েলারী, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী ও ফার্নিচার পণ্যগুলো বেছে নেওয়া হয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় রাসেল দম্পতি। এসব পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির বিশাল আকারে দায় (খরধনরষরঃরবং) তৈরি হয়। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইভ্যালির ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল, নতুন গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়ে পুরোনো গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের (খরধনরষরঃরবং) আংশিক করে পরিশোধ করা। অর্থাৎ দায় ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাসেল। তিনি জানান, রাসেল ও তার স্ত্রীর ইভ্যালি প্রতিষ্ঠান চলতো পরিবার নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত ব্যবসায়িক গঠনতন্ত্রে। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতা দেখিয়েছেন তারা। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি ছিল। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্থায় উপনীত হয়েছে।
মুক্তি চেয়ে আদালতের সামনে বিক্ষোভ: ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলের মুক্তির দাবিতে এবার আদালতের সামনে বিক্ষোভ করেছেন গ্রাহকরা। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে এ বিক্ষোভ করেন তারা। এদিন দুপুর ২টার দিকে ইভ্যালির সিইও রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে আদালতে আনা হয়। পরে বিকেল ৩টার দিকে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। এ খবর শোনার পর ৪০-৫০ জন গ্রাহক আদালতের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা ইভ্যালির সিইও রাসেল ও তার স্ত্রী নাসরিনের মুক্তি দাবি করেন। তাদের দাবি- রাসেলকে গ্রেফতার না করা হলে তারা দ্রুত পণ্য অথবা টাকা ফেরত পেতেন। তবে রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেওয়ায় তাদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এজন্য তারা বিক্ষোভ করছেন। পরে পুলিশ তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এসময় একজনকে আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন কোতয়ালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মো. নাজমুল হোসেন। তিনি জানান, বিক্ষোভকারীদের আদালতের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসময় একজনকে থানায় নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে।
চেয়ারম্যান-এমডি ৩ দিনের রিমান্ডে : অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলামের আদালতে তাদের হাজির করা হয়। এরপর গুলশান থানায় প্রতারণার অভিযোগে করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশার থানার উপ-পরিদর্শক ওয়াহিদুল ইসলাম। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিটন তাদের রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আসামিদের বিরুদ্ধে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিন দুপুর ২টার দিকে তাদের আদালতে হাজির করে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে আসামিদের তোলা হয় আদালতে। এর আগে দুপুর ১টায় র্যাব সদর দপ্তর থেকে রাসেল দম্পতিকে র্যাবের সাদা প্রাইভেটকারে করে গুলশান থানায় আনা হয়। সেখান থেকেই পরে নেয়া হয় আদালতে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ইভ্যালি এমডি রাসেলের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযান শেষে বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এ দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর র্যাবের সাদা গাড়িতে করে তাদের নেওয়া হয় র্যাব সদর দপ্তরে, সেখানেই চলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ। গত বুধবার রাতে আরিফ বাকের নামে ইভ্যালির এক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও সিইও রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা করেন।
সর্বশেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩:৩৬
পাঠকের মন্তব্য