জাপানের সঙ্গে ২৫০ কোটি’ডলারের সহায়তা চুক্তি সই

টোকিওতে গতকাল যৌথ সংবাদ সম্মেলনে করমর্দন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ছবি : এএফপি
টোকিওতে গতকাল যৌথ সংবাদ সম্মেলনে করমর্দন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ছবি : এএফপি

পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের সঙ্গে ২৫০ কোটি ডলারের (প্রায় ২১ হাজার ৬০ কোটি ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা) উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। গতকাল বুধবার টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের উপস্থিতিতে এ চুক্তি সই হয়। চুক্তি সইয়ের আগে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে বসেন দুই প্রধানমন্ত্রী। তাঁদের সঙ্গে দুই দেশের নীতিনির্ধারক ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তারা অংশ নেন।

চুক্তি সইয়ের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্নপূরণে জাপানের সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন শিনজো আবে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে বিশেষ জায়গা রয়েছে জাপানের জন্য।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মনোয়ার আহমেদ এবং বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোইয়াসু ইজুমি নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। ৪০তম অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ওডিএ) প্যাকেজ চুক্তির অধীনে জাপানি এই অর্থে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১), বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ্বালানি দক্ষতা ও সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (পর্যায়-২) ও মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে (৫) অর্থায়ন করা হবে।

জাপান এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী। ১৯৭২ সাল থেকে দেশটির কাছ থেকে বাংলাদেশ মোট এক হাজার ১৩০ কোটি ডলারের সহায়তা পেয়েছে।

চুক্তি সইয়ের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি আমরা। এ লক্ষ্য পূরণে জাপান আমাদের পাশে থাকবে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে যাবে বলে প্রধানমন্ত্রী আবে আমাকে নিশ্চিত করেছেন।’

শেখ হাসিনা স্বাধীনতার পর থেকেই জাপানের সহায়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জাপানের ঐতিহাসিক উন্নয়ন থেকে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে পারি যে সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এখন আমরা সঠিক পথ ধরেই এগিয়ে চলেছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে জাপান সব সময় আমাদের পাশে আছে।’ শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরো শক্তিশালী ও সম্প্রসারণ করার বিষয়ে বেশ কিছু নতুন ধারণা (আইডিয়া) নিয়ে আলোচনা করেছি।’

সম্ভাব্য যেসব ক্ষেত্র থেকে দুই দেশই লাভবান হতে পারে, সেগুলো নিয়ে কাজ করার বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীই একমত হয়েছেন বলে জানান তিনি। আঞ্চলিক কানেকটিভিটির বিষয়ে শিনজো আবের সঙ্গে আলোচনার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নেও জাপান সহায়তা দেবে বলে শিনজো আবে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়টিও দুজনের আলোচনায় স্থান পেয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মতো বিষয়গুলোতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ ও জাপান একে অপরের প্রতি সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা। আড়াই বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি করায় শিনজো আবেকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিও উঠে আসার কথা জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মানবিক ও রাজনৈতিক সংকটের বিষয়ে টেকসই ও দ্রুত সমাধানের উপায় খোঁজার বিষয়ে তাঁরা একমত হয়েছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি জাপান অনুভব করতে পারছে। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করে তারা।

বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে সহযোগিতা ও অংশীদারির নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি ও আবে আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।’

বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ জাপানে চার দিনের সফরে গত মঙ্গলবার রাজধানী টোকিওতে পৌঁছেন শেখ হাসিনা। চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর শেখ হাসিনার এটিই প্রথম জাপান সফর।

গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান শিনজো আবে। এ সময় সুসজ্জিত একটি দল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেয়। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক শুরু হয়।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে শিনজো আবের বাসভবনে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক নৈশভোজে যোগ দেন শেখ হাসিনা।

চুক্তি সই অনুষ্ঠানের আগে গতকাল সকালে হোটেল টোকিওর নিউ অটানিতে বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের (বিজেবিএফ) বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে জাপানের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি। জাপানের ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির উচ্চ প্রশংসা করেন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে নেওয়া বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করেন।

আজ বৃহস্পতিবার ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সম্মেলনে তিনি এশিয়ার সম্ভাবনা ও উত্থান নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরবেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও তাত্ত্বিকদের সামনে। একই মঞ্চে আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদেরও থাকার কথা রয়েছে। সেখানে দুই নেতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেরও আশা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৯, ০৫:২৯
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও