ছোটবেলায় পড়েছিলাম, “সবার সুখে হাসবো আমি,কাঁদবো সবার দুঃখে।নিজের খাবার বিলিয়ে দিবো অনাহারী মুখে”
নীতি আর আদর্শের এই কথাগুলো শুধুমাত্র বইয়ের পাতাগুলোকেই সৌন্দর্য মন্ডিত করে। বাস্তবে আজ এই কথাগুলো বড্ড সেকেলের হয়ে গেছে, এখন মূলত চলে,
“সবার দুঃখে হাসবো আমি, কাঁদবো সবার সুখে। পরের খাবার কেড়ে খাবো,অনাহারী মরে মরুক ধুকে”।
কারণ, আজ আমি কুঁড়েঘরের সেই ছোট্টো খোকা/খুকি সমাজের উঁচুতলার মানুষ। আজ আমার নামের আগে পেছনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিষ্টার ডিগ্রি যে লাগানো!!
সমাজের ঐ নিচুতলার মানুষগুলোকে বড্ড জঞ্জাল মনে হয়,ওদের দেখলেই নাকটা চেপে ধরতে ইচ্ছে করে ,কারণ দুবেলা দুমুঠো খেয়ে ওদের পকেটে যে পারফিউম কেনার টাকাটা থাকে না!!
হ্যাঁ এটা কোনো উপন্যাস কিংবা গল্প নয়,আজকের সমাজের একাংশ শিক্ষিত সমাজের প্রতিচ্ছবি। আমরা আজ লেখাপড়া করে ভালো একটা চাকরি পেয়ে সমাজের ঐ নিচুতলার মানুষগুলোকে অনেকটাই ভুলেগেছি। ভুলে গেছি, একটা সমাজকে যদি একটা পরিপূর্ণ মানুষের ন্যায় ধরা হয়, তাহলে প্রতিটা পেশার মানুষগুলো শরীরের এক একটা অঙ্গ। যার যেকোনো একটির অনুপস্থিতিতে আপনি পঙ্গু হিসেবে বিবেচিত হবেন!!
অথচ সেই মানুষগুলোকেই সমাজের এক শ্রেণীর উচুতলার মানুষ চুষে চুষে নিঃশেষ করে দিচ্ছে!
একবার ভাবুন তো, আজ যদি জুতা সেলাই করা ঐ মুচি তার কাজ বন্ধ করে দেয় তাহলে আপনার আমার কি হবে?
সকাল ৫ টায় উঠে আপনাকে আমাকে জুতাটা ঠিক করতে হবে। যে কাজের মেয়েটার সাথে আপনি প্রতিদিন খারাপ ব্যবহার করছেন সেই কাজের মেয়েটা যদি বাসায় কাজ করা বন্ধ করে দেয় তাহলে ঘরের বাসি থালাবাসন পরিষ্কার করা, ময়লা জামাকাপড় ধোয়া,ঘর মোছা, ঝাড়ু দেওয় এসব কাজ আপনাকেই করতে হবে।যে বৃদ্ধ ড্রাইভারের সাথে আপনি তুই বলে সম্মোধন করছেন,৫ টাকা ভাড়া বেশি চেয়েছে বলে যে আপনি তার গায়ে হাত তুলছেন সেই রিক্সাওয়ালা যদি রিক্সা চালানো বন্ধ করে দেয় তাহলে আপনাকে কিন্তু হেটে হেটেই কলেজ,ভার্সিটি কিংবা অফিসে যেতে হবে। আপনার অফিসের ঐ ক্লার্ককে পান থেকে চুন খসতেই যে বকাঝকা করছেন, ভেবে দেখেছেন ঐ একা মানুষটা কিভাবে সারাদিন পুরো অফিসের সকলের চাওয়া মাত্রই চা- নাস্তার যোগান দিচ্ছে..?
হ্যাঁ এটাই আমরা ভাবি না, আর ভাবিনা বলেই আমাদের নীতি আর নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েই চলছে।
একটা বাস্তব ঘটনা বলি, বছরখানেক আগে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিস্কার কর্মীরা দীর্ঘ দিনের বেতন বকেয়া থাকায় আন্দোলনে নেমেছিলো এবং সকল প্রকার কাজ থেকে বিরত থাকলো। যে কারনে প্রতিটা বাসার ময়লা রাস্তা ঘাটে দিনে দিনে স্তুপে পরিনত হলো। পুরো বরিশাল জুড়ে ময়লা আবর্জনা আর দূর্গন্ধে একটা অসস্থিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে গেছিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে তাদের দাবী-দাওয়া দ্রুত মেনে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু যদি এভাবে আর কিছু দিন চলতে থাকতো তাহলে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মানুষ বরিশাল ছেড়ে বাঁচার জন্য হলেও পালাতো।
এভাবেই সমাজের উচু নিচু সব শ্রেনীর মানুষগুলো একজন অন্য জনের কাছে কোন না কোনো ভাবে ঋণী। আজ সরকারি কলেজ,বিশ্বিবদ্যালয়, মডিকেল কলেজে থেকে সমান্য কিছু টাকার বিনিময় অর্জন করা ডিগ্রি আমার অহংকারের মূল কেন্দ্রবিন্দু! একটা বেসরকারি ভার্সিটি থেকে ডিগ্রি অর্জন করতে যেখানে ৫-২৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হয় সেখানে আপনি সরকারি বিশ্বিবদ্যালয় থেকে ৫০ হাজার টাকায় ডিগ্রি নিচ্ছেন। সত্যি কি আপনার পেছনে এই ৫০ হাজার টাকাই খরচ হয়,,,,,?
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন(ইউজিসি) দেওয়া তথ্য মতে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে ১ লাখ ১ হাজার ২০৮ টাকা খরচ হয়। তাহলে আপনি বছরে কতটাকা বিশ্বিবদ্যালয়কে দেন? আর এই টাকাগুলো কিন্তু সরকার তার নিজের পকেট থেকে দেয় না, সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই আপনাকে শিক্ষত করছে,আপনাকে উচ্চতর ডিগ্রি দিচ্ছে। যাতে করে লেখাপড়ার শেষে আপনিও সমাজের ঐ গরীব মানুষগুলোকে সেবা দিতে পরেন।
কিন্তু জনগনের টাকায় পড়া সেই ডাক্তার যখন রুগীর সেবা না করে টাকা উপার্জনের মেশিনে পরিনত হয়,টাকার অভাবে যখন একটা গরীব রুগী ধুকে ধুকে মারা যায় আর তা ডাক্তার দেখেও না দেখার বান করে তখন তা সমাজের জন্য সত্যিই লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায় । আর এই চিত্র আজ সমাজে অহরহ সবখানেই কম বেশি দেখা যাচ্ছে। মানুষের মাঝে মূল্যবোধের বড় অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। পরীক্ষায় নলক না করতে দেওয়া শিক্ষককে যখন ছাত্রের হাতে মার খেত হয় তখন সমাজের করুন পরিনতি ছাড়া আমি চোখে আর কিছুই দেখি না।
এতোগুলা হতাশার মধ্যেও যখন শুনি কাজকর্ম হীন বেকার বাবা তার শিশু বাচ্চার জন্য দুধ চুরি করতে গিয়ে ধরা খায়,আবার সেই পুলিশ কর্মকতাই যখন তার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তখন মনে হয়,এতোগুলা নীতি নৈতিকতাহীন শিক্ষিতর মধ্যে অন্তত একটা আদর্শবান মানুষ হয়েছে!..
যেটা সবারই হওয়ার কথা ছিলো,কিন্তু টাকার লোভ আর উচ্চ বিলাসিতা আমাদের মনকে পশু করে দিয়েছে। সৎ চরিত্র নামের শব্দটাকে সমাজ থেকে বিতারিত করেছে।
তাই আসুন প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সৎ হই৷ এই সমাজটা তো আমাদেরই কর্মের ফল নিয়ে গড়ে উঠবে। আজ আপনি যে ভাবে সমাজটাকে রেখে যাবেন আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিক তেমনই পাবে। আপনি কি চান আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্যায় অত্যাচারে নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা সমাজের বাসিন্দা হোক,,,,,???
সর্বশেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৯, ২৩:৩৮