* পায়ে হেটে চাকরিজীবীদের ঢাকায় প্রবেশ
* সুযোগ বুঝে সিএনজি ভাড়া চারগুণ বৃদ্ধি
* চেক পোষ্ট থেকে দুরপাল্লার বাস ফেরত
করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধ ও রাজধানী ঢাকাকে সুরক্ষিত রাখতে আশপাশের ৭ জেলায় লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই এ সকল জেলায় লকডাউন শুরু হয়েছে। তবে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। বিশেষ করে বিপাকে পড়েছে নারায়ণঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় চাকরির উদ্দেশ্যে আসা লোকজন। পরিবহন না পেয়ে কেউ পায়ে হেটে কেউ চারগুন ভাড়া দিয়ে সিএিনজিতে যাতায়াত করছে। বেশী বিপাকে পড়েছে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াতকারী দুরপাল্লার বাসে এসে নারায়ণগঞ্জ সীমানায় নামার পর কেউ আটকা পড়েছে মেঘনা গজারিয়া এলাকায় কেউ ভুলতা গাউছিয়া এলাকায়। তবে সাইনবোর্ড পর্যন্ত আসা প্রায় ৫শতাধিক বাসকে ফেরত পাঠিয়েছে প্রশাসন।
মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে নারায়ণগঞ্জ জেলায় শুরু হয়েছে কঠোর লকডাউন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে, যা চলবে ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত। এ লকডাউনে কোনও প্রকার গণপরিবহন নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রায় ৫ শতাধিক নারায়ণগঞ্জমুখি যানবাহন ফিরিয়ে দিয়েছেন লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনের দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
জানা গেছে, কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনের কয়েকটি ম্যাজিস্ট্রেটি টিম মাঠে কাজ করছে। তার মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় সকাল ৬টা থেকে অবস্থান নিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) গোলাম রেজা মাসুম প্রধান।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় লকডাউন কঠোরভাবে প্রতিপালনের জন্য সাইনবোর্ড এলাকায় জেলার অভ্যন্তরে প্রবেশ ও বের হওয়ায় মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলার অভ্যন্তরে কোন পরিবহন আমরা ঢুকতে দিচ্ছি না। এ পর্যন্ত ২০০ থেকে ২৫০ যানবাহন ঘুরিয়ে দিয়েছি। তবে জরুরি পরিষেবার আওতাভুক্ত কিছু পরিবহন প্রবেশ ও বের হতে দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা শহরের ভাষা শহীদ রফিক সড়কে দু-একটি রিকশা, অটোরিকশা চলাচল করছে। সকাল থেকেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যানবাহন চলাচলে তদারকি করছে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা পুলিশ। এ সময় বিভিন্ন যানবাহন ও মোটরসাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং অনেক যানবাহনকে ঢাকার দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
তবে মহাসড়কে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি, প্রাইভেটকার, দূরপাল্লার পরিবহন বাস, ট্রাক চলতে দেখা গেছে। লকডাউন উপেক্ষা করে অনেক মানুষকে কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে। সড়কে যানবাহন না থাকায় অনেকে হেঁটেই কর্মস্থলে যাচ্ছেন। তবে জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশকে বাসস্ট্যান্ডে যানবাহন চলাচলে কঠোর নজরদারি করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া জেলা শহরের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট সকাল থেকেই বন্ধ রয়েছে।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কথা হলে লাভলু মিয়া নামে একজনের সঙ্গে। তিনি জানান, সাভারের একটি বেসকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। দুইদিন আগে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। লকডাউনের বিষয়টি না জানার কারণে বিপাকে পড়েছেন তিনি। তবে চাকরি বাঁচাতে যেকোনোভাবে তাকে কর্মস্থলে যেতে হবে।
আমেনা বেগম নামে একজন বলেন, মেয়ে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। হঠাৎ করে লকডাউনের খবর শুনে বিপাকে পড়েছি।
ঢাকার লালবাগে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অপেক্ষা করছেন কয়েকজন। তারা বলেন, এখন কেমনে যামু? সকাল থেকে বসে আছি। কোনো গাড়ি চলতাছে না। এই লকডাউনের জন্য খুব ভোগান্তিতে পড়েছি। রামপ্রসাদ নামে এক রিকশাচালক বলেন, কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। রিকশা নিয়ে বের হয়ে দেড় থেকে দুইশ টাকা আয় হচ্ছে। এর মধ্যে আবার লকডাউন চলতাছে। কিভাবে যে পরিবারের লোকগুলোর মুখে খাবার তুলে দিব? বাধ্য হয়েই রিকশা নিয়ে বের হইছি। রিকশা না চালাইলে খামু কী? লকডাউন দিয়া করমু কী?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা কৃষি অফিসে চাকরি করেন তিনি। লকডাউনের বিষয়টি জেনে তিনি মোটরসাইকেল রেখে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। ধামরাইয়ের মইশাসি থেকে অনেক কষ্টে মানিকগঞ্জের বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসেছেন। এখানে এসে আর কোনো যানবাহনই পাচ্ছেন না। এখন তার কর্মস্থলে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দায়িত্বরত জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিলুফা ইয়াসমিন নিপা বলেন, সরকার ঘোষিত লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন কাজ করছে। সকাল থেকে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পাটুরিয়ামুখী বেশ কয়েকটি গাড়িকে ঢাকার দিকে ফিরেয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাস্ক না পরার তিনজনকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
লকডাউনের কারণে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে সব ধরনের লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে এ রুটে ফেরি চলাচল করছে। অনেকে জেনে আবার অনেকে না জেনে ঘাটে এসে বিপাকে পড়ছেন।জরুরি কাজ থাকায় শিমুলিয়া ঘাটে এসেছেন মাদারীপুরের তৌহিদ ইসলাম। তিনি জানান, জরুরি প্রয়োজনে শ্যামলী থেকে ভেঙে ভেঙে শিমুলিয়ায় এসেছেন। রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে পুলিশ তল্লাশি করছে। পরে পুলিশকে বুঝিয়ে তিনি ঘাটে এসেছেন।
শিমুলিয়া ঘাট এলাকা থেকে ঢাকা যাচ্ছেন নিরব আহমেদ নামে একজন। তিনি বলেন, ঘাটের একাধিক স্থানে পুলিশ পাহারায় রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে জরুরি প্রয়োজনে এক বড় ভাইয়ের প্রাইভেটকারে চড়ে ঢাকা যাচ্ছি। শ্রীনগর উপজেলার মহসড়কের পাশেও বিভিন্ন স্থানে পুলিশ টহল দিচ্ছে। দূরপাল্লার কোনো গাড়ি চলতে দিচ্ছে না।
শিমুলিয়া ঘাটের বি আইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা মো. সোলাইমান বলেন, শিমুলিয়া ঘাট থেকে সকল ধরনের স্পিডবোট ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ঘাটে কোনো যাত্রীর চাপ নেই। তবে পণ্যবাহী কিছু পরিবহন ঘাটে রয়েছে।
মাওয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সিরাজুল কবির লেন, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে মঙ্গলবার সকাল থেকে ১৪টি ফেরি চলছে। সকল
ধরনের লঞ্চ, স্পিডবোট, ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঘাটে যাত্রীর চাপ নেই।
গাজীপুরে লকডাউনের প্রথম দিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-ট্ঙ্গাাইল মহাসড়কে দূরপাল্লা ও আঞ্চলিক সড়কে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের তৎপরতায় বন্ধ হয়ে যায় এসব যানবাহন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন কর্মস্থলমুখী মানুষ।
গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনাগামী জসিম উদ্দিন জানান, কোনো গাড়ি না পেয়ে সকাল ১০টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গাজীপুর শহর থেকে গ্রামের বাড়ি শ্রীপুরের জৈনা বাজারে যান। এ সময় তাকে এক হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। অথচ অন্য সময় বাসে গেলে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা আর সিএনজিতে ৫০০ টাকা লাগত।
টঙ্গী থেকে শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন মাহমুদ রাজ। তিনি বলেন, সকালে অফিস যাওয়ার সময় কোনো গণপরিবহন না পেয়ে অটোরিকশা এবং হেঁটে অফিসে পৌঁছায়। এতদূর অটোরিকশা না যাওয়ায় একাধিকবার গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে। ভাড়াও গুনতে হয়েছে দ্বিগুণ।
শ্রীপুরের মাওনা মহাসড়ক থানার ওসি মো. কামাল হোসেন জানান, সকালে কিছু নাইট কোচ যাত্রী নিয়ে গেছে। পরে বাস থামিয়ে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ-গাজীপুরের সীমান্তবর্তী জৈনা এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সেখান থেকে গাজীপুরগামী সব গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। টঙ্গী থেকে উত্তরবঙ্গগামী বাসা আটকে দেওয়া হয়েছে।
কোনাবাড়ির সালনা হাইওয়ে মহাসড়কের ওসি মীর গোলাম ফারুক জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কিছু নাইট কোচ ছেড়ে দেওয়া হলেও পরে সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সকালে অফিসগামী কিছু যাত্রী নিয়ে অটোরিকশা চলার কথা তিনি স্বীকার করেছেন।
লকডাউন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, মঙ্গলবার থেকে গাজীপুরে ৯ দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। সে লক্ষ্যে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ শহরের প্রবেশদ্বারগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে যান চলাচল ও সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। ঢাকা থেকে আসা এবং ঢাকায় ঢোকার সময় পুলিশের চেকপোস্টে পড়তেই হবে।
সর্বশেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২১, ১২:৪৬
পাঠকের মন্তব্য