রাজধানীর ক্লাবগুলো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভাগাড়

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

ঢাকার ক্লাবগুলোতে কী হচ্ছে? ২০১৯ সালে ক্যাসিনোকাণ্ডে ক্লাবগুলো নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হওয়ার পর সম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে রাজধানীর একটি ক্লাব। অভিযোগ রয়েছে-অভিজাত ক্লাবগুলোতে মদ, জুয়াসহ দেদারছে চলছে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকজন এবং প্রভাবশালীদের যাতায়ত সেখানে। চিত্রনায়িকা পরীমনির ঘটনায় বোট ক্লাব নিয়ে যে তোলপাড় হয় শেষপর্যন্ত তা জাতীয় সংসদ পর্যন্ত গড়ায়। এই নিয়ে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। অভিজাত বিভিন্ন ক্লাবে বড় অংকের টাকা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা কীভাবে সদস্য হন-এই প্রশ্ন ওঠে সংসদে।

৮ জুন চিত্রনায়িকা পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এরপর জানা যায় বোট ক্লাবের আলো নিভিয়ে অভিনেত্রীকে মারধর করা হয়েছে। পরীমনি অবশ্য আলো নেভানোর কথা তার অভিযোগে উল্লেখ না করলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। তবে এর আগে ক্লাবের ভেতর নায়িকাকে গালাগালের যে একটি ভিডিও প্রকাশ হয়েছিল, সেখানে অন্ধকার দেখা গেছে।  তবে ক্লাবের বার রুমে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঘটনার সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। ক্লাবের বারজুড়ে অন্ধকার হয়ে যায়। এরপর শোনা যায় অশোভনীয় গালাগাল। পুরুষ ও নারী কণ্ঠের চিৎকার। এর মধ্যেই ঠাসঠাস শব্দ। যেন কেউ কারো গায়ে হাত তুলছে। ব্যথা পেয়ে শব্দ করছে কেউ। বেশ কয়েক মিনিট এভাবেই মারধরের ঘটনা ঘটে। যখন বিদ্যুৎ আসে তখন প্রায় অচেতন ছিলেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। এক পর্যায়ে কস্টিউম ডিজাইনার জিমি ও ক্লাবের নিরাপত্তাকর্মীর সহযোগিতায় বের করা হয় তাকে।

এদিকে বিভিন্ন ক্লাব, মদ এবং জুয়া নিয়ে সংসদে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন জাতীয় পার্টি, বিএনপি, তরিকত ফেডারেশন এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের সদস্যরা। অনির্ধারিত এই বিতর্কের সূত্রপাত করেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, কয়েকদিন ধরে একজন চিত্রনায়িকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বোট ক্লাবের নাম আলোচনায় এসেছে এবং সে প্রেক্ষাপটে এখন বিভিন্ন ক্লাবের নানা অনিয়মের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হচ্ছে। জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য বলেছেন, ক্লাব সংস্কৃতি, মদ এবং জুয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন যেমন উঠেছে, সেখানে কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবের অভিযোগও রয়েছে। সেকারণে তিনি প্রশ্নগুলো সংসদে তোলেন বলে উল্লেখ করেন।

ঢাকা শহরে বিভিন্ন ক্লাব আছে, সে সব ক্লাবে আসলে কি হয় - আমরা জানি না। আমরা প্রায়ই দেখি যে এখানে ক্লাবে জুয়া খেলা হয়, ক্লাবে মদ খাওয়া হয়। বাংলাদেশেতো যাদের মদ পান করার লাইসেন্স আছে, তারাই শুধু মদ খেতে পারে। এগুলো দেখা হয় কীনা, সেই প্রশ্ন আমাদের বলেন মুজিবুল হক চুন্নু। বিভিন্ন ক্লাবে মদ আমদানি এবং বিক্রি কী পরিমাণে করা যাবে সেটা লাইসেন্সের শর্তে নির্দিষ্ট করা থাকে। চিত্রনায়িকা পরীমনির দায়ের করা মামলায় ঢাকা বোট ক্লাবের তিনজনসহ মোট পাঁচজনকে ইতোমধ্যে গ্রপ্তার করেছে। তাদেরকে পুলিশ রিমাণ্ডে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সুলতানা কামাল মনে করেন, ক্লাব গঠন বা মানুষের সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার থাকলেও কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জবাবদিহিতার প্রয়োজন আছে। ক্লাব কালচার বলতেই যে সেটা খারাপ-আমি তা মনে করি না। সেই ক্লাব কী করছে- কোন ধরনের নাগরিককে কী ধরনের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে-যারা সদস্য হচ্ছেন-তাদের করের বিষয় কি হচ্ছে-এসব প্রশ্ন দেখার বিষয় আছে বলে সুলতানা কামাল মনে করেন। তবে বিভিন্ন ক্লাবের সাথে জড়িতদের অনেকে কোন ক্লাবের সদস্য করার ক্ষেত্রে বড় অংকের টাকা নেয়াসহ এখন আলোচনায় আসা বিভিন্ন অভিযোগ মানতে রাজি নন।

এরআগে ২০১৯ সালে ঢাকার বেশ কয়েকটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে জুয়া খেলার সামগ্রী ও মদ উদ্ধার করে পুলিশ। সবগুলোই মতিঝিলের বেশ সুপরিচিত ক্লাব। ফুটবলের ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের সাথে আছে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব। সেসময় একের পর এক অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে চলা চারটি ক্যাসিনো বন্ধ করে দেয়।  এরপর হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতেই পারে - ক্লাবগুলো প্রতি মৌসুমে ফুটবলের পেছনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তা কী এই ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে আসতো? তবে দেশের ক্লাবগুলো মূলত স্পন্সর আর ডোনারদের থেকে অর্থ নিয়ে চালায়, বলে  ফুটবল ক্লাবগুলোর কর্তারা এমনটাই দাবি করেছেন। ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্র খেলাধুলার কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়নি। তবে ক্যাসিনোকাণ্ডে জুয়া বাণিজ্য নিয়ে পুরো দেশ কাঁপিয়ে গণমাধ্যমে ক্লাবগুলোর সরব উপস্থিতি হয় ক্লাবগুলো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম। এরপর অভিযান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টি ক্লাব এমনকি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে পর্যন্ত। এখানেই শেষ নয়। চট্টগ্রামের আবাহনী লিমিটেড, মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবেও চলে একই রকম অভিযান।  তাতে প্রমাণ মেলে ক্লাবগুলো মাঠের খেলা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিল জুয়ার আখড়া।  আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ক্রীড়া ক্লাবগুলোর এই ক্যাসিনো ক্লাবে রূপান্তর হয় সংগঠকদের প্রশ্রয়ে এবং তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

জানা গেছে, আয়ের উৎস হিসেবে দেশের অনেক ফুটবল ক্লাবে ‘হাউজি’ খেলা শুরু হয় আশির দশকের দিকে।  তবে নব্বইয়ের দশকে জুয়ার আসরও জমে ওঠে। গত কয়েক বছরে তা আরো ভয়াবহ মাত্রা পায়। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের অনেক ক্লাবেই গড়ে ওঠে ক্যাসিনো। ঢাকায় ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় যুবলীগের আলোচিত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ দেড়জন নেতা-কর্মীকে। সঙ্গে তার অন্যতম সহযোগী এনামুল হক আরমানকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরমধ্যে রয়েছেন ঠিকাদারসহ কয়েকজন প্রভাবশালী। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডেও নেয়া হয় সবাইকে।

ক্যাসিনো কাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া,  প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম, মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু,  রুপম ভুঁইয়া এবং অনলাইন ক্যাসিনো এর মূল হোতা সেলিম প্রধান। গ্রেফতার অভিযানে প্রায় সবার কাছে থেকে মোটা অংকের নগদ টাকা, অবৈধ অস্ত্র, স্বর্ণ, মাদক জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী। ক্লাবে মাদক-সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৪০ টির মতো অভিযান পরিচালিত হয়।

সর্বশেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২১, ১২:৪০
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও