ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেনি প্রস্তাবিত বাজেটে

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিলেও উপকরণের ব্যয় বৃদ্ধিতে মাঝপথে তা থমকে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারের ভাবনার সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেনি প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে। করোনা মহামারিতে মানুষের যেখানে আয় কমেছে সেখানে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার সামগ্রীর দাম বাড়বে। এ সব সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্তরায় হিসাবে দেখছেন তারা।

জানা গেছে, করোনা মহামারিতেও কমছে না মুঠোফোনে কথা বলা কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ। প্রস্তাবিত বাজেটে টেলিকম সেবায় কমানো হয়নি সম্পূরক শুল্ক কিংবা সিমট্যান্স। সুখবর নেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারেনট সেবায়ও। শিল্প খাতে করপোরেট করহার কমানোর প্রস্তাব করা হলেও বিবেচনায় নেয়া হয়নি মুঠোফোন অপারেটরদের। খরচ বাড়ছে মুঠোফোনে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রেও। সবমিলিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটকে হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেনি।

অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী দেশিয় পণ্য সুরক্ষায় শুল্ক আরোপের ফলে আমদানি করা স্মার্টফোনের দাম আরেক দফা বাড়তে পারে। স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়লেও দেশে মোট গ্রাহকের প্রায় ৭০ শতাংশ এখনও ফিচার ফোন ব্যবহার করেন। ফিচার ফোন আমদানিতে বর্তমানে ৩৫ শতাংশের বেশি আমদানি শুল্ক রয়েছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার হিসাবে, চলতি বছর জানুয়ারি নাগাদ দেশে ১২টি মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় সব কারখানা উৎপাদন ও সংযোজন শুরু করেছে। মোবাইল সিম ব্যবহারের করে সেবা গ্রহণের বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মোবাইল ফোনে কথা বলা, বার্তা পাঠানো এবং ডেটা ব্যবহারের খরচ বেড়ে যাবে।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফোনের সিম কার্ডে সম্পূরক শুল্কহার ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে সিম কার্ডের ওপর সম্পূরক কর ছিল ১৫ শতাংশ। এবার ২০ শতাংশ আরোপ হলে তা দাঁড়াচ্ছে ৩৫ শতাংশ।  জানা গেছে, দেশে এখন ৭টি প্রতিষ্ঠান সিম কার্ড তৈরি করা হয়। সিম কার্ডের চাহিদার ১০ শতাংশেরও কম সিম আমদানি করা হয়। আর বাকি ৯০ শতাংশ সিম দেশেই তৈরি হয়।

করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগ থেকে দাপ্তরিক কাজকর্ম, কেনাকাটা, আর্থিক লেনদেন সবই চলছে মুঠোফোন কিংবা ইন্টারনেটে। ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মুঠোফোনে কথা বলা কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ কমাতে কর ছাড়ের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু গত ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উত্থাপিত বাজেটে মুঠোফোন সেবায় ভ্যাট এবং সম্পুরক শুল্ক ১৫ শতাংশ কোনো হেরফের হয়নি। কমানো হয়নি ২০০ টাকা সিমট্যাক্সও। মুঠোফোনে ১০০ টাকার কথা বলায় ৩৩ টাকা ২৫ পয়সা এবং ডাটা ব্যবহারে প্রায় ২২ টাকা খরচ অপরিবর্তিত থাকছেই।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, সম্পূর্ণ না কমালেও যেন ৫ শতাংশ কমানো হয় সেটি আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এই বাজেটে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি আমরা লক্ষ্য করলাম না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। করপোরেট করকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা উল্লেখ করে আসছে মুঠোফোন সেবাদাতারা। তবে উত্থাপিত বাজেটে পাবলিকলি ট্রেডেড মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ৪০ শতাংশ; পাবলিকলি ট্রেডেড নয় এমন অপারেটরদের ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর হার অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে হতাশ অপারেটররা।

রবির হেড করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স সাহেদ আলম জানান, ন্যূনতম করপোরেট কর এটা আমাদের অনেক দিনের দাবি। আমরা মনে করি এটা সম্পূর্ণ একটি অযাচিত কর। এটাকে যাতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা দেয়া হয় সেই আশা আমরা করছি। যে কোনো পণ্যের ওপর সবোর্চ্চ ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। তবে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের দাবি, এই সেবায় এখনো প্রায় ৯৮ লাখ গ্রাহককে সর্বোচ্চ ২০শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আমলে নেয়া হয়নি বিষয়টি। আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম জানান, প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রাহকরা এখনো ১৫-২০ শতাংশ ভ্যাট দিচ্ছে। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে এনবি আরের প্রতি যে অনুরোধ ছিল যে এই ৫ শতাংশ ভ্যাটকে প্রত্যেকটা লেয়ারে সমভাবে বন্টণ করে দেয়া যেতে পারে বলে আমাদের একটা ধারণা ছিল।

এদিকে দেশে কার্যরত মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত লেনদেন মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান আমানত নিতে পারছে না, তবে গ্রাহকদের টাকার একটি অংশ তাদের কাছে জমা থাকে। ব্যাংকের মতো ঋণ কার্যক্রম বা অন্য কোনো সেবাও নেই এসব প্রতিষ্ঠানের। এরপরও বিকাশ-নগদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ব্যাংকের সমান করপোরেট কর আদায়ের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এমএফএসের করপোরেট কর সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাজেটের নতুন এ প্রস্তাবের ফলে মুনাফা করলেই এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগের চেয়ে বেশি করপোরেট কর দিতে হবে। তবে এই খাতের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান এখনো মুনাফায় না থাকায় করপোরেট কর বাড়ানোর প্রভাব আপাতত তাদের ওপর পড়বে না। করপোরেট কর দিতে না হলেও লোকসানি এসব প্রতিষ্ঠানকে বর্তমানে লেনদেনের ওপর দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। এবারের বাজেটে তা কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে সরকার। ফলে আপাতত বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ তৈরি হবে না বলে মনে করছেন কর কর্মকর্তারা। তবে দীর্ঘ মেয়াদে চাপে পড়বে পুরো খাত। ফলে বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ বিনিয়োগও কমে আসতে পারে।

এই খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র ১০ বছর হলো এই খাত যাত্রা শুরু করেছে। এই খাতের কোম্পানিগুলোকে এখনো প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। নতুন নতুন সেবা চালু করতে হবে। দেশের আর্থিক খাতের ডিজিটাল লেনদেন বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো। এ সময়ে কর বাড়িয়ে খাতটির অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাজেটে অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এমএফএস কোম্পানির ক্ষেত্রে করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আর তালিকাভুক্ত না হলে করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার কথা বলেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো এমএফএস প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। ফলে সবাইকে ৪০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হবে।২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট কর কমানোর ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে করে

রকেট, বিকাশ কিংবা নগদের মতো মোবাইল ফোন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) ওপর কর বাড়ায় ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই বাড়তি কর কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস্ অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি)। এমএফএস কোম্পানিগুলোর করহার বাড়ানোর প্রস্তাবে সামগ্রিক ডিজিটালাইজেশনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটি।

সর্বশেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২১, ১২:৫৬
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও