দিশেহারা নগরবাসী সিলেটে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কায়

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

সাত দফা ভূ-কম্পনের পর সিলেটের মানুষ বড় ভূমিকম্পের যে শঙ্কা নিয়ে ১০ দিন পার করেছেন, সোমবারের ভূমিকম্প সেই শঙ্কা আর আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। উঁচু ভবনে থাকা নগরবাসীর মনে ভয় আরও বেশি। সেই সঙ্গে ভূমিকম্প ঝুঁকি থাকলেও ভূমিকম্প হলে কি ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে হবে সে বিষয়েও পুরোপুরি অবগত না নগরবাসী।

এদিকে সোমবারের ভূমিকম্পের পর নড়েচড়ে বসেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। ৩০ মে ২২টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে ১০ দিন বন্ধ রাখতে যে নোটিশ দিয়েছেন তার কার্যকারিতা মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। নতুন করে আবারও ভূমিকম্প হওয়ায় এসব ভবন ঝুঁকিমুক্ত না করে তা ব্যবহারের অনুমতি দেবে না সিসিক। এমন তথ্য জানিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান।

তিনি বলেছেন, এ কারণে এক মাসের একটি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যেই যেসব ভবন প্রকৌশল দিক থেকে শক্তিশালী করে ঝুঁকিমুক্ত করা যাবে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে ভবন মালিককে। আর যে সব ভবন কোনোভাবেই ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব নয় তা অপসারণ করতে হবে। ভবন মালিক অপসারণ না করলে সিসিক অপসারণ করবে, খরচ বহন করতে হবে ভবন মালিককে।

এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় ৩.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নগরীর বন্দরবাজার এলাকার রাজা গিরিশ চন্দ্র স্কুলের দোতলা ভবনে বড় বড় ফাটল দেখা দেওয়ায় পরিদর্শন শেষে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছেন শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল হাকিম।

যারা উঁচু ভবনে থাকেন তাদের কেউ কেউ বলছেন ভূমিকম্প হলে কি করতে হবে তারও পরিষ্কার ধারণা নেই। দ্রুত সচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু করে নগরবাসীকে ভূমিকম্প হলে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। নগরীর মির্জাজাঙ্গাল এলাকার বাসিন্দা বাপ্পা ঘোষ চৌধুরী বলেন, তিনি পাঁচতলা ভবনে থাকেন। ৩০ মে আতঙ্কিত হয়ে তিনি গ্রামে চলে যান, ১০ দিন পার হওয়ায় তিনি গ্রাম থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এসেই আবার ভূমিকম্প অনুভব করেছেন। এখন কি করবেন তা নিয়ে দিশেহারা তিনি।

সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ওই ২২টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন খুলে দিতে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। খুব শিগগিরই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পূরকৌশল বিভাগের সঙ্গে চুক্তি সই করবে সিসিক। যে চুক্তির আওতায় নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটি বহুতল ভবন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণা করা হবে।

এদিকে, ঘন ঘন এমন ভূকম্পন নিয়ে বাংলাদেশ ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোমেনুল হক যুগান্তরকে বলেন, এমন ছোট ছোট ভূ-কম্পন সিলেট অঞ্চলে এর আগেও হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রস্থল দূরে থাকা এবং ভূপৃষ্ঠের অনেক গভীরে সৃষ্টি হওয়ায় ভূ-কম্পনগুলো সাধারণত অনুভব করা যায় না। কিন্তু তা পর্যবেক্ষণ সেন্টারে ধরা পড়ে। গত তিন বছরে সিলেট স্টেশনে ধরা পড়া ছোট ছোট ভূ-কম্পনগুলো তারা ইতোমধ্যেই খতিয়ে দেখেছেন।

কিন্তু সেগুলোর মাত্রা খুবই কম ও ভূপৃষ্ঠের অনেক গভীরে সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোর কেন্দ্রস্থল ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি হওয়ায় তার মাত্রা কম হলেও বেশি ভূ-কম্পন অনুভূত হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব ভূ-কম্পন কেন ঘটছে তা গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তবে যেহেতু সিলেটের পাশেই প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের ডাউকি ফল্ট লাইন সেখানে বড় ভূমিকম্পের সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক।

এ ছাড়া এত বড় ফল্ট লাইনের পাশে যে আরও ছোট ছোট ফল্ট লাইন তৈরি হয়নি তাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেট অঞ্চলে এই মুহূর্ত থেকে সচেতনতা বাড়াতে হবে, সেই সঙ্গে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি কিভাবে কমানো যায় সে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে।

আর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম যুগান্তরকে জানান, ঘন ঘন এমন ভূমিকম্পে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তার বেশ কিছু কারণও আছে। তিনি বলেন, ১৮৯৭ সালে এ অঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার ছয় মাস আগে থেকেই এমন ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়েছে।

সেদিক থেকে বিচার করলে এমন ঘন ঘন ভূ-কম্পনে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার বেশ কারণ রয়েছে। অন্যদিকে ১৯১৮ সালে যে বড় ভূমিকম্প হয়েছে তার আগে কিন্তু এমন ছোট ছোট ভূ-কম্পন হয়নি। তার মানে এই নয় যে, বড় ভূমিকম্প হবে না। দুধরনের তথ্যকেই সামনে রাখতে হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এবারের ভূমিকম্পের সবকটির কেন্দ্রস্থল সিলেট অঞ্চলে। এ ছাড়া সোমবার সন্ধ্যায় যে ৩.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে তার কেন্দ্রস্থল সিলেট শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জালালপুরে এবং এটা হয়েছে মাত্র ৬০০ মিটার নিচে। সে কারণেই সামান্য মাত্রা হলেও বড় ঝাঁকুনি অনুভব হয়েছে। ভূ-তলের এত কাছাকাছি ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়া সত্যিই আতঙ্কের। তাই নগরবাসীকে এই মুহূর্তে সচেতন থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

রাজা গিরিশ চন্দ্র স্কুল ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা : ভূমিকম্পের পর বিমসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দেয় বন্দরবাজারের রাজা গিরিশ চন্দ্র হাইস্কুলের দোতলা ভবনের নিচতলায়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০০৬ সালে নিচতলা হস্তান্তর করেন। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় তলা হস্তান্তর করা হয় বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মুমিত। খবর পেয়ে রাতেই ভবনটি পরিদর্শন করেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

যেহেতু ভবনটি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর তৈরি করে তাই ভবনটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভার তাদের উপরই ছেড়ে দেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ভবনটি পরিদর্শনে যান সিলেট শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল হাকিমসহ একটি দল। ভবনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নজরুল হাকিম গণমাধ্যমকে জানান, যেহেতু দোতলা ভবনের নিচতলা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাই ঝুঁকি না নিয়ে ভবনটিকে তারা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন।

সিলেটে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দোকান খোলা রাখায় জরিমানা : সিলেটে তীব্র শঙ্কার মাঝেও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দোকান খুলে ব্যবসা করার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছেন। নগরীর কয়েকটি দোকানের মালিককে মঙ্গলবার এই জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া সড়কে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে সিলেটে সিটি করপোরেশন। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযুক্তদের তিন হাজার ১০০ টাকা জরিমানা করেন।

সর্বশেষ আপডেট: ৯ জুন ২০২১, ১৩:১২
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও