মাতৃগর্ভে আমি যখন ভ্রুণ হয়ে পৃথিবীতে যাত্রা শুরু করি, ঠিক তখন আমার আগমন বার্তাটির অপেক্ষায় ছিল আমার পুরো পরিবার। আগমনের আগেই সবার একটাই প্রত্যাশা ছিল আমার ভ্রুণটি যেন হয় ছেলেশিশু। দীর্ঘ প্রত্যাশার পর অবশেষে মেয়েশিশু হয়েই পৃথিবীতে আগমন করি। অপ্রত্যাশিত মেয়েশিশু হয়ে পৃথিবীতে এসেই আমি আমার অধিকারের জন্য চিৎকার করেছিলাম।
একটি শিশু তার প্রিয় পরিবারের সহযোগিতা ও সাহচার্যে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে। আর পরবর্তীতে তার সমৃদ্ধি ঘটে শিক্ষা জীবনে এবং সর্বশেষ বাস্তবায়ন ঘটে তার কর্মজীবনে।
দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে মেয়েশিশুর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এদের মধ্যে খুব স্বল্পসংখ্যক মেয়েশিশুই তাদের ন্যূনতম অধিকার ভোগ করে একটি সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। দেশের অধিকার বঞ্চিত মেয়েশিশুর একটি বড় অংশ বাবা-মায়ের অমনোযোগিতা, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টির অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বাল্যবিবাহ আর সামাজিক কুসংস্কারের কারণে বড় হয়ে বঞ্চনার শিকার হয়। একটি বিশেষ জরিপে উপরোক্ত সমস্যার কারণে পাঁচ বছরের নিচে প্রতি হাজারে মেয়েশিশুর মৃত্যুর হার প্রায় ৫৮ শতাংশ। আবার আমার গবেষণায় দেখেছি এর সংখ্যা গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৭০ শতাংশের কাছাকাছি।
বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় সাত লাখ, এর মধ্যে শতকরা ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ পথশিশু মেয়ে। এই মেয়েশিশুরা জীবন কাটায় এক ভয়াবহ ঝুঁকিতে। একে তো পথশিশু, তারপর আবার মেয়েশিশু। গবেষণা করে বুঝতে পারলাম, তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ আর তৈরি হয়ে ওঠে না। মূল্যবোধ একজন মানুষের ভিতরকার বিষয়। এগুলো কোনো লিখিত বিধি-বিধান নয়। মানুষের ভিতরে মূল্যবোধ তৈরি হয় তার পারিপার্শিক অবস্থা এবং চর্চার মধ্য দিয়ে। তারা আজও একটি সুন্দর নিরাপদ পরিবেশ থেকে বঞ্চিত।
বড় হয়ে মেয়েশিশু হয়ে যায় নারী আর ছেলেশিশু হয়ে যায় পুরুষ। পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের ভূমিকা অপরিহার্য। মানে পুরুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী আর নারী সিদ্ধান্ত পালনকারী। আজও মেয়েশিশু বেড়ে ওঠে পুরোটাই মান্ধাতা আমলের মন-মানসিকতার সংসারে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ-ি পেরিয়ে যাওয়ার আগেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েশিশুদের বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়। বাল্যবিবাহ মেয়েশিশুর শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত করে। ব্যক্তিগত বিকাশ বা উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে ফেলে। বাল্যবিবাহের কবলে পড়া মেয়েশিশুকে পারিবারিক নির্যাতনের দুর্ভোগও পোহাতে হয়। কখনো অকারণে তালাকপ্রাপ্ত হয় এসব অন্যায় প্রতিরোধে রাষ্ট্রের উদ্যোগ উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।
আজও বাংলাদেশে ৬৬ ভাগ মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়, যা পরবর্তীতে তালাক, নারী নির্যাতন আর মাতৃমৃত্যুর মতো কঠিন ব্যাধিতে পরিণত হয়। পরিবার বা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা একবারও ভাবে না, বিয়ে আসলে কোনো জবরদস্তি বাঁধন নয়। বিয়েতে উভয়ের আত্মার সম্মতি চাই। যেখানে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি হয় আর মিলনের পরিবর্তনে কলহ হয়, সেখানে উভয়ের সম্মতি বড়ই প্রয়োজন।
মেয়েশিশু বলে পরিবার যে বৈষম্যের মাঝে তাকে বড় করে সেখানে বৈচিত্র্যের বড়ই অভাব থাকে। মেয়েদের শিক্ষা তাদের মন-রূপ ক্ষেত্রের উৎকর্ষ সাধনের কোনো চেষ্টাই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র করে না। অথচ বিভিন্ন মানব চরিত্র এবং জীবনের কর্মবৈচিত্র্য মনুষ্যকে জ্ঞানী এবং লোকচরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তোলে।
মেয়েশিশুর প্রতি বৈষম্য সমাজে অনেক গভীরে প্রোথিত। যুগ যুগ ধরে সমাজ কাঠামো মেয়েশিশুর প্রতি যে বৈষম্যকে মদদ বা প্রশ্রয় দিয়ে আসছে সে সমাজকে বদলাতে গেলে প্রয়োজন সচেতনতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা এবং রাষ্ট্রীয় বহুমাত্রিক তৎপরতা। অথচ সংসদে যে বাল্যবিবাহ নিরোধ সংক্রান্ত আইন পাস হয়েছে তার ১৯ ধারায় যে বাল্যবিবাহের বিশেষ বিধান রাখা হযেছে তা দুর্ভাগ্যজনক।
আইনকে শ্রদ্ধা করি; কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়, এই আইন যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সরকারের ভূমিকায় গোটা রাষ্ট্রে যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমে যায়। নতুন আইন তাতে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।
মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, নিরাপত্তার অভাব, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অসচেতনতা, প্রচলিত প্রথা, কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, চলমান আইন ইত্যাদি কারণে ধীরে ধীরে মেয়েশিশুকে কোণঠাসা করে সংকীর্ণ মন আর নির্যাতনের খুব কাছে পৌঁছে দেয়।
সব বৈষম্য দূর হয়ে মেয়েশিশু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে হোক আশীর্বাদ। বাল্যবিবাহ কিংবা বৈষম্য রেখে আমরা যেন মেয়েশিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘন না করি। মেয়েশিশুর বেলায় ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে গড়ে তুলি সুন্দর, সাবলীল, বৈচিত্র্যময় পৃথিবী আর সেই সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই ‘ছেলেমেয়ে বিভেদ নাই, সবাই সুন্দর করে বাঁচতে চাই’।
লেখক : মানবাধিকার কর্মী ও পাথরঘাটা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান