ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে দেশের করোনা পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতির জন্য লকডাউনের দিকে যাচ্ছে সরকার। বন্ধ করা হয়েছে সব রকমের বিনোদন কেন্দ্র। বন্ধ করা হয়েছে নির্বাচন। সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে। বিদেশ থেকে দেশে আসা লোকদের নিশ্চিত করা হচ্ছে কোয়ারেনটেইন। বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬,৪৬৯ জন। এটিই হচ্ছে এ পর্যন্ত একদিনে শনাক্ত হওয়া সবচেয়ে বেশি সংখ্যা। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে প্রতিদিনই যে খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে গত ২৪ ঘণ্টার পরিসংখ্যান সেটি নির্দেশ করে। সংক্রমণে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর বিশ্বে একদিনে ১২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
পরীক্ষা বিবেচনায় একদিনে শনাক্তের হার ২৩ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮,১৯৮টি পরীক্ষা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ৩০ জুনের পর এটিই দেশে সর্বোচ্চ মৃত্যু। ওই দিন দেশে ৬৪ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ১০৫ জনের। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬৯ জন। সবমিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ১৭ হাজার ৭৬৪ জনে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ঢাকা সিটিসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন দুই হাজার ৫৩৯ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩৮ জন।
এদিকে, মাত্র একদিনের ব্যবধানে দেশে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা মাত্র ৬টি থেকে বেড়ে ৩১টি হয়ে গেছে। অন্যান্য সময়ের মতো ঢাকাতে সংক্রমণ বেশি শনাক্ত হলেও গত দুই সপ্তাহে মৌলভীবাজারে সর্বোচ্চ সংক্রমণের হার দেখা গেছে। তিন সপ্তাহ আগে যেখানে এই জেলায় সংক্রমণের হার ছিল পাঁচ শতাংশ, সেখানে গত দুই সপ্তাহে সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশ।
এছাড়াও মুন্সীগঞ্জ ও চট্টগ্রামে গত দুই সপ্তাহে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণের হার দেখা গেছে। রাজধানী ঢাকায় গত দুই সপ্তাহে সংক্রমণের হার ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ। ইতোমধ্যেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বিশেষ নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২২৬ টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১২০ টি, জিন-এক্সপার্ট ৩৩ টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৭৩ টি। এসব ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ২৮ হাজার ১৯১ টি। আগে নমুনাসহ মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৮ হাজার ১৯৮ টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪৬ লাখ ৯৮ হাজার ৭৭৪ টি।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৮ দশমিক ২১ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৭ শতাংশ।
বিজ্ঞপ্তিতে নাসিমা সুলতানা জানান, ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৫৯ জনের মধ্যে ৩৫ জন পুরুষ, ২৪ জন নারী। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪০ জন, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে পাঁচজন করে ১০ জন, খুলনা বিভাগে চারজন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দুইজন করে চারজন ও বরিশাল বিভাগে একজন রয়েছেন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে মারা গেছেন ৫৭ জন, বাড়িতে দুইজন।
মৃতদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরে ঊর্ধ্বে ৩০ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১৩ জনজন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১১ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে চারজন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে একজন রয়েছেন। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে এসেছেন ৪১৪ জন ও আইসোলেশন থেকে ছাড় পেয়েছেন ১৭০ জন। এ পর্যন্ত আইসোলেশনে এসেছেন এক লাখ পাঁচ হাজার ২৭৫ জন। আইসোলেশন থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৯৩ হাজার ৩০৮ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ১১ হাজার ৯৬৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের জেলাগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে যেসব স্থানে সংক্রমণের হার টানা দুই সপ্তাহ ১০ থেকে ২০ শতাংশ বা তার উপরে, সেগুলোকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যেসব স্থানে সংক্রমণ হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ সেসব স্থানকে মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও যে সব স্থানে শূণ্য থেকে পাঁচ শতাংশের মধ্যে সংক্রমণ হার আছে সেসব এলাকাকে নিম্ম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন এলাকার নমুনা পরীক্ষা ও সংক্রমণ শনাক্তের হার অনুযায়ী উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল ছয়টি জেলা। এগুলো হলো মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর। এদিন মধ্যম থেকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ছিল ১৯টি জেলা। এগুলো হলো মৌলভীবাজার, সিলেট, নরসিংদী, রাজবাড়ী, ফেনী, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, রাজশাহী, নড়াইল, নীলফামারী, গাজীপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, নওগাঁ, রংপুর, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল।
এ দিন শনাক্তের হার বিবেচনায় কম ঝুঁকি থেকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে হিসেবে ছিল পাঁচটি জেলা। এগুলো হলো- নোয়াখালী, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর ও নাটোর। কিন্তু একদিনের ব্যবধানে দেখা যায় দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে আরও ২৫টি জেলা। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের সংক্রমণ শনাক্তের হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বে করোনায় একদিনে ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। মোট মৃত্যু ২৮ লাখ ২৭ হাজার ছাড়িয়েছে। একদিনে শনাক্ত হয়েছে ৬ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি। মোট শনাক্ত ১২ কোটি ৯৪ লাখ ছাড়িয়েছে। ব্রাজিলে গেল একদিনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৯শ ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একদিনে শনাক্তেও শীর্ষে দেশটি। নতুন প্রায় ৯০ হাজার শনাক্ত হয়েছে ব্রাজিলে। ভারতে একদিনে ৪শ ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনাক্ত আরও ৭২ হাজারের বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে একদিনে ১ হাজার ১শ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনাক্ত ৬৮ হাজারের বেশি। মেক্সিকোতে একদিনে ৮শ ৭ জনের প্রাণ গেছে। পোল্যান্ডে একদিনে ৬শ ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ফ্রান্সে চার সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। দেশটিতে একদিনে ৩ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একদিনে শনাক্ত হয়েছে ৪১ হাজারের বেশি।
এদিকে যুক্তরাজ্য ছাড়া পুরো ইউরোপ এবং বিশ্বের ১২ দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে আগামিকাল শনিবার থেকে, বলবৎ থাকবে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত। ইউরোপের বাইরে নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন দেশগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, জর্ডান, কুয়েত,
বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন সদস্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী এম জিয়া উল কবির স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, এয়ারলাইন্সগুলো তালিকাভুক্ত ১২টি দেশের ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের বহন করতে পারবেন তবে সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের ট্রানজিটের সময় বিমানবন্দরেই থাকতে হবে। অন্য যাত্রীদের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা আগে করা করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলকভাবে প্রদর্শন করতে হবে এবং বাংলাদেশে আসার পর ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
সর্বশেষ আপডেট: ২ এপ্রিল ২০২১, ১১:০০
পাঠকের মন্তব্য