তিন কারণে দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা আমলে নিচ্ছে না সাধারণ মানুষ। একদিকে মাস্ক পরতে অনীহা অন্যদিকে স্বাভাবিক সময়ের মতই চলছে সামাজিক নানা অনুষ্ঠান। অন্যদিকে দিনে দিনে দেশে করোনা ভাইরাসে মৃত্যু ও শনাক্ত বাড়ছে। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। করোনা পরীক্ষা করতে বুথগুলোতে তৈরি হচ্ছে লম্বা লাইন। মার্চের শুরু থেকে গত তিন সপ্তাহে করোনা শনাক্তের হার দুই থেকে বেড়ে ১১শতাংশে এসে ঠেকেছে। এমন পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে তিনটি বড় কারণ চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাফেরা; টিকা আসায় ‘কোনো ভয় নেই’ মনোভাব এবং সংক্রমক ভাইরাসটি প্রতিরোধে আবশ্যকীয় মাস্ক পরিধানে অনীহা সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। সরকারকে তারা এ বিষয়ে কঠোর হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। অন্যথায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুহাম্মদ মুশতাক আহম্মেদ বলেন, ‘অবশ্যই শনাক্তের এমন হার আশঙ্কাজনক। আমাদের জন্য উদ্বেগজনকও। কারণ বাস্তর পরিস্থিতি আরো খারাপ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শেষ হলে সেটা দেখা যাবে। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করায় এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে এমন মন্তব্য করে এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, মাস্ক পরা, আক্রান্তদের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন পুরোপুরি নিশ্চিত না করলে কোনো লাভ হবে না। এখনই সিরিয়াস হতে হবে। কারণ করোনার এখনকার ধরণ কিন্তু ভিন্ন।

এদিকে করোনার সংক্রমণের গতি টানতে কয়েকমাস পর আবারো শুরু হয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত চলছে অভিযান। মাস্ক না থাকলে গুনতে হচ্ছে জরিমানা। এছাড়াও পুলিশের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে মাস্ক। এছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হচ্ছে। আনন্দভ্রমণ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হলেও থেমে নেই কোনো কিছু।

এমন বাস্তবতায় রোগীর সংখ্যা আরো বেড়ে গেলে সঠিক চিকিৎসা নেয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এখনই যদি সতর্ক না হই, স্বাস্থ্যবিধি না মানি, তাহলে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। যা আমরা এখনও বুঝতে পারছি না। কারণ, আমাদের হাসপাতালগুলোতে তো লাখো মানুষের জায়গা হবে না। কোথায় চিকিৎসা হবে? কে চিকিৎসা দেবে এত মানুষকে?’

গতবছরের মার্চে দেশে করোনার প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। একমাস পর ওইবছরের মে থেকে শনাক্তের হার বাড়তে থাকে। সবথেকে বেশি সংক্রমণ পৌঁছায় জুলাই মাসে। সেসময় সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ ছািেড়য় গেলেও আগস্ট থেকে সংক্রমণের হার নামতে থাকে। নভেম্বরে কিছুটা ওপরে ওঠার পর ডিসেম্বরে আবার নামতে শুরু করে। যা চলতি বছরের প্রথম দুইমাসে কমতির দিকেই ছিল। কিন্তু মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আবার বাড়তে থাকে। যা ক্রমেই বাড়ছে।

মার্চের শুরুর দিকে ৩ মার্চ থেকে শনাক্তের সংখ্যা টানা তিনদিন (৬১৪, ৬১৯, ৬৩৫) ছয়শোর বেশি হয়। এরপর ৯ মার্চ ৯১২ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পরীক্ষা বিবেচনায় তখন শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। ১৪ মার্চের পর থেকে হঠাৎ করেই সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে যায়। সেদিন আক্রান্ত হয় ১৭৭৩ জন। সবশেষ সোমবার ৯ মাস পর বেশি শনাক্ত হয়। একদিনে শনাক্ত হয় ২ হাজার ৮০৯জন। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় যার শনাক্তের হার ১১ দশমিক ১৯।

এদিকে করোনার প্রকোপ বাড়ায় নতুন করে লকডাউন দেয়াসহ ১২দফা সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গুঞ্জন আছে, গতবছরের মত লকডাউনের বদলে সহসাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা হতে পারে। যদিও ছুটির বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এবিষয়ে কোনরকমের সিদ্ধান্ত হয়নি বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লকডাউনের সুপারিশের সঙ্গে দ্বি-মত প্রকাশ করেছেন করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ কমাতে এরআগে লকডাউনের চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু কার্যকর হয়নি। সামনেও হবে না। শুধু শুধু মানুষের দুর্ভোগ হবে। তার থেকে মক আপ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের করোনা পরীক্ষা করা যেতে পারে। এটা ভালো হবে।

একই ধরণের কথা বলেছেন ডা. মুশতাক আহম্মেদও। তিনি বলেন, ‘লকডাউন দেশে খুব একটা কার্যকর হবে বলে মনে করি না। সেক্ষেত্রে বেশি সংক্রমিত এলাকার সব বাসিন্দাদের একযোগে করোনা পরীক্ষা করে দ্রুত রিপোর্ট দিতে হবে। যাদের পজিটিভ আসবে তাদের আইসোলেশনে পাঠাতে হবে। আশপাশের লোকদের কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কোনো উদ্যোগেই লাভ হবে না।

এদিকে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে তিনটি বড় কারণ চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাফেরা; টিকা আসায় ‘কোনো ভয় নেই’ মনোভাব এবং সংক্রমক ভাইরাসটি প্রতিরোধে আবশ্যকীয় মাস্ক পরিধানে অনীহা সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। এছাড়া মহামারী সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণাতেও ঘাটতি রয়েছে বলেও মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গরমের সময়ে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝার জন্য গবেষণার প্রয়োজনীতা রয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘শীত-গরমের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সম্পর্ক নেই। যখনই মাস্ক না পরে, স্বাস্থবিধি না মেনে মানুষ অবাধে ঘুরে বেড়াবে তখনই সংক্রমণ বাড়বে। স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মানা হলে তখন সংক্রমণও কমে আসবে।’এদিকে করোনার সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়াসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা, মাস্ক পরা নিশ্চিতের পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

তাদের সুপরিশের বলা হয়, সবসময় আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসটি একটি রহস্যময় আচরণ করেছে। এখন সংক্রমণ বাড়ছে। বড় মাত্রার না হলেও সংক্রমণের অল্প ঢেউ সামনে আমাদের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে। সেই বিষয়ে প্রস্তুতি রাখতে হবে। করোনার সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রটি বুঝতে গবেষণা জরুরি। এরজন্য বাজেট দরকার।

সর্বশেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২১, ০১:৪২
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও