আবারো বিশ্বজুড়ে বাড়তে শুরু করেছে করোনা আতংক। নতুন স্ট্রেইন চলে আসার কারণেই এই আতংক বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। ফলে ফের লকডাউনের পথে হাটছে বিভিন্ন দেশ। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুযায়ী জার্মানিতে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ। ফের লকডাউনের পথে হাটতে চলেছে ইতালি। আগামিকাল সোমবার থেকে রাজধানী রোম থেকে শুরু করে মিলান সর্বত্রই শুরু হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। দেশজুড়ে লকডাউন হওয়ার আগে এটা প্রাথমিক প্রস্তুতি বলে মনে করা হচ্ছে।
ইস্টারের সময় গোটা দেশ ঘরবন্দী হয়ে থাকবে বলেই পরিকল্পনা করছে সরকার। দৈনিক সংক্রমণ ইতিমধ্যেই ২৫ হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। মানুষের মনে ফের নতুন করে ফিরছে আতঙ্ক। এদিকে ইতালিতেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ গেছে। সেখানেও আবার আতংক হয়েই ফিরছে করোনা। অন্যদিকে জার্মানির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তা জানিয়েছেন, শুরু হয়েছে তৃতীয় সংক্রমণের ঢেউ। জোরেসোরেই চলছে টিকাকরণের কাজও। তবে ভাইরাস এখনও হারিয়ে যায়নি। তবে দ্রুত টিকাকরণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছে সেখানকার প্রশাসন। তবে শুধু এই দুটি দেশ নয়, নতুন স্ট্রেইনের আতঙ্ক ছড়িয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও।
আমেরিকার অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল হলেও সামান্যতম ঢিলেমি ফের বাড়িয়ে দিতে পারে সংক্রমণের সংখ্যা। প্রতিটি দেশ ইতিমধ্যেই করোনার নিয়মাবলিতে জোর দিয়েছে। তবে গাছাড়া মনোভাব হলেই ফের সংক্রমণ বাড়াবে বলে সকলের মত। বিশ্বের আরের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে,করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবারও লকডাউনে যাচ্ছে ইতালি। শিগগিরই দেশটির স্কুল, রেস্তোরাাঁ ও দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হবে।
২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর ইতালিতে এক লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। বৃহস্পতিবার দেশটিতে নতুন করে প্রায় ২৬ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে এবং মারা গেছেন ৩৭৩ জন আক্রান্ত। গত মার্চে দেশটিতে প্রথম দফায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়। দুই মাসের বেশি সময় পর মে মাসে লকডাউন প্রত্যাহার করা হয়। সংক্রমণ বাড়ায় ডিসেম্বরের শেষ দিকে আবারও এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
তৃতীয় দফায় লকডাউন ঘোষণার জন্য শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘির মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। সম্প্রতি ইতালিতে করোনার নতুন রূপ সংক্রমণ ঘটিয়ে যাচ্ছে। দেশটির উত্তরের জনবহুল অঞ্চল লোম্বার্ডি ও দক্ষিণের ক্যালাব্রিয়াকে ‘রেডজোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। লাজিও অঞ্চলেও রেডজোন ঘোষণা হতে পারে। নতুন জোট সরকার চলতি মাসের শুরুর দিকে রেডজোনগুলোতে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এখানে বার, রেস্তোরাঁ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতে থাকারও নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
করোনার নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এটা সহজেই সংক্রমণে সক্ষম এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে গুরুতর অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। যা বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটিতে। বরফাচ্ছন্ন কানাডার প্রধান চারটি প্রদেশে প্রতি বছরই বছরের এই সময়টায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। কিন্তু গত একবছরে তা আর পরিলক্ষিত হচ্ছে না। করোনায় সারা বিশ্বের সাথে কানাডাকেও যেন থমকে দিয়েছে।
করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আবার বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় কানাডা ডে উপলক্ষে সিটি পরিচালিত ও অনুমোদিত সব ধরনের আউটডোর অনুষ্ঠান বাতিল করেছে টরন্টো। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন টরন্টো মেয়র জন টরি। নগরীতে রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার বেড়ে ১ দশমিক ১ এ উন্নীত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন টরন্টো জনস্বাস্থ্য বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. এইলিন দ্য ভিলা। যদিও গত সপ্তাহে এটা ছিল দশমিক শূন্য ৮। ডা. এইলিন দ্য ভিলা রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার হঠাৎ বেড়ে যাওয়াকে হতাশাজনক বলে মন্তব্য করার পরই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষ।
দেশটির সরকারের বেঁধে দেয়া বিধিনিষেধ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সত্বেও নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট দেশটির সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বর্তমানে দেশটিতে জনসাধারণের নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন বিধিনিষেধ বলবৎ রয়েছে। ইতিমধ্যে গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার সীমান্ত বন্ধ রয়েছে।
করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার নতুন রূপ দেখছে ব্রাজিল। দেশটিতে একদিনে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছে। ব্রাজিলের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আইসিইউ এখন রোগী দিয়ে পূর্ণ। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনে রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যুর আশঙ্কায় ভ্যাকসিনটির প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও আইসল্যান্ড। অস্ট্রিয়াতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় একজনের মৃত্যুর পর, ওই একই চালানের ভ্যাকসিন নেয়া এক নারীর ডেনমার্কে মৃত্যু হলে ওই সিদ্ধান্ত আসে।
ইটালিতেও ভ্যাকসিন নেয়া এক ৫০ বছর বয়সী ব্যক্তির রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণের ফলে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো প্রমাণ মেলেনি বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সংক্রমণ রোধে মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়িয়েছে পর্তুগাল।এদিকে চলমান মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এবং ভাইরাসটির নতুন ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় আবারও লকডাউনে যাচ্ছে ভারত। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহরে এ দফায় সবার আগে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। শুক্রবার এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
আগামিকাল সোমবার থেকে এখানে সপ্তাহব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ভারতের এ শহরটি বরাবারই করোনার হটস্পট হিসেবে পরিচিত। ভারতে সবচেয়ে বেশি এক কোটি ১০ লাখ করোনা রোগী শনাক্ত হয় এ রাজ্যে। এ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক লাখ ৫৭ হাজার বাসিন্দা।এ বছরের জানুয়ারি থেকে ভারতে করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। দেশটিতে এ পর্যন্ত ২ কোটি মানুষ করোনার টিকা পেয়েছেন।
ভারতজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি চলার মধ্যে মহারাষ্ট্রে সংক্রমণ বাড়ার এ চিত্র দেশটির কর্মকর্তাদের উদ্বেগও বাড়িয়ে দিয়েছে। লকডাউন থাকলেও নাগপুরে টিকাদান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী নিতিন রাউত। “সরকারি দপ্তর ও শিল্পকারখানায় ২৫ শতাংশ উপস্থিতি বাদে সব প্রতিষ্ঠান ও অপরিহার্য নয় এমন সব দোকান বন্ধ থাকবে,” বলেছেন তিনি।
এদিকে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরো ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৮ হাজার ৫২৭জনে। নতুন করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ১০১৪ জন। মোট শনাক্ত ৫ লাখ ৫৬ হাজার ২৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ১১৩৮জন এবং এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ১০ হাজার ৩১০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে আরো জানানো হয়, ২১৯টি পরীক্ষাগারে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ হাজার ৭৯টি নমুনা সংগ্রহ এবং ১৬ হাজার ২০৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪২ লাখ ৪৮হাজার ৩৪৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
গত একদিনে বিশ্বে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ৩৬১ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৪১৪ জন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, শনিবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ২৬ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ জন। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৫ হাজার ৫৮১ জন মানুষ।এই মহামারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যু সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিতের সংখ্যা ২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৩ হাজার ৪২৩ জন। দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৪ জন।
ভারতকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসা ব্রাজিলে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩১৬ জন। দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন ২ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৬ জন। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪৯১ জন। দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮৩ জন। তালিকায় রাশিয়ার অবস্থান চতুর্থ। পঞ্চম স্থানে ব্রিটেন। বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩।
সর্বশেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২১, ১১:৫২
পাঠকের মন্তব্য